সকল মেনু

বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশের বাজারে বন্ড কেন জনপ্রিয় নয়

বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের কাছে বন্ড মার্কেট অনেক জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশের বাজারে বন্ড ততটা জনপ্রিয় হয়নি। এর পেছনে গ্রাহকের বন্ডের বিষয়ে অনাগ্রহ যতটা দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী মার্কেট ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা বন্ডের বাজার অবকাঠামো।

যথেষ্টসংখ্যক প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতা ও কিছু ব্যক্তি পর্যায়ে বন্ডের গ্রাহক থাকা সত্ত্বেও কার্যকর বাজার অবকাঠামোর অভাবে এ দেশে বন্ডের ব্যবসা কখনই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে ওঠেনি। বিধিবদ্ধ নিয়মাবলির কারণে এসএলআর সংরক্ষণের তাগিদে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ডে বিনিয়োগ করে।

বাংলাদেশে প্রচলিত বন্ডগুলোকে প্রাথমিকভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, যার প্রথমটি হলো সরকারি ট্রেজারি বন্ড। আর দ্বিতীয়টি হলো বেসরকারি বন্ড। বর্তমানে সরকারি ট্রেজারি বন্ডের হার তুলনামূলক কম হলেও নিজেদের টাইম ও ডিমান্ড ডিপোজিটের ১৩ শতাংশ সরকারি বিল-বন্ড কিনে এসএলআর হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয় বিধায় ব্যাংকগুলো একরকম বাধ্য হয়ে এ বন্ডে বিনিয়োগ করে।

আমাদের দেশে জাতীয় বাজেট সাধারণত ঘাটতি বাজেট হয়। বাজেটের এ ঘাটতি পূরণ করা হয় দেশী ও বিদেশী ঋণের মাধ্যমে। সরকারের দেশী ঋণের উৎস দুটি। এর মধ্যে প্রথমটি হলো, সরকার সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ঋণ নেয়। আর দ্বিতীয়টি হলো, সরকারি বিল-বন্ড বিক্রি করে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকগুলোর কাছে বিল-বন্ড বিক্রি করে সরকারকে ঋণ হিসেবে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত সরকারি ট্রেজারি বন্ড পাঁচ ধরনের। বন্ডগুলো হলো দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড, পাঁচ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড, ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড, ১৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড এবং ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড।

বর্তমানে উল্লিখিত পাঁচ ধরনের বন্ডের সুদহার যথাক্রমে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ৬ দশমিক ২৫, ৭ দশমিক ১০, ৭ দশমিক ৫৮ ও ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। দুই বছর আগে (জানুয়ারি ২০২০) ওই বন্ডগুলোর সুদহার ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ৮ দশমিক ৯৭, ৯ দশমিক ২৩, ৯ দশমিক ৩৯ ও ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। প্রতি মাসের প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার একটি করে বন্ডের আর শেষ সপ্তাহে মঙ্গলবার দুটি বন্ডের নিলাম হয়। সরকারের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামের পরিমাণ নির্ধারণ করে। ওই নিলামে তালিকাভুক্ত সব ব্যাংক অংশগ্রহণ করে।

সরকারি আরেকটি বন্ড এসএলআর আইটেম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়, তা হলো সরকারি সুকুক বন্ড। সুকুক বন্ড আমাদের দেশে নতুন হলেও বিশ্বব্যাপী এটি একটি জনপ্রিয় বন্ড। ইসলামী শরিয়াভিত্তিক বন্ড হওয়ায় অনেকের কাছে এটি খুবই পছন্দের। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত সুকুক বন্ড দুটি। আমাদের দেশে সুকুক বন্ড দুটির নিলাম হয় ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ও ২০২১ সালের ১০ জুন। সুকুক বন্ড দুটি প্রকল্পভিত্তিক বন্ড, যার সুদহার যথাক্রমে ৪ দশমিক ৬৯ ও ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ বন্ডের মেয়াদ পাঁচ বছর। সুকুক বন্ডের বিপরীতে সরকারের দুটি চলমান প্রকল্প হলো ঢাকা শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহকরণ প্রকল্প এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী সরবরাহকরণ প্রকল্প।

আমাদের দেশে সরকারি বন্ডের পাশাপাশি রয়েছে কিছু বেসরকারি বন্ড। এ বেসরকারি বন্ডগুলোয় বিনিয়োগ করলে তা এসএলআর সংরক্ষণের উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয় না। সরকারি বন্ডের তুলনায় এ বন্ডগুলোয় ঝুঁকি বেশি হওয়ায় এতে মুনাফার পরিমাণও বেশি। বেশির ভাগ বন্ডে ব্যক্তি পর্যায়ে বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের এখনো কোনো নজির নেই।

২০১০ সালে বৈশ্বিক ব্যাংকিং খাতে ব্যাসেল-৩ উদ্ভাবিত হয়। মূলত ব্যাংকের সংকট মোকাবেলায় শক্তিশালী মূলধন ব্যবস্থাপনার ভূমিকা নিয়েই ব্যাসেল-৩ নীতিমালার উদ্ভব হয়। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক ব্যাসেল গাইডলাইনের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিআরপিডি সার্কুলার নং-১৮, ডিসেম্বর ২০১৪-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য নীতিমালা প্রকাশ করা হয়। ওই নীতিমালার পরিশিষ্ট-৪-এ ব্যাংক কর্তৃক সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুর নীতিমালা জারি হয়।

যদি কোনো ব্যাংক সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যু করে তাহলে সমপরিমাণ টাকা ওই ব্যাংকের টায়ার-২ মূলধন হিসেবে বিবেচিত হবে। এ সুবিধা পাওয়ার পর তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ ব্যাংকই সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যু করে। এ বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো সাময়িকভাবে মূলধন ঘাটতিজনিত সমস্যা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকিং কোম্পানিগুলো এ বন্ড ইস্যু করতে পারে।

তবে এ বন্ডে অনেকেরই বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও ব্যাংকগুলোকেই বিনিয়োগ করতে দেখা যায়। প্রথম দিকে সাব-অর্ডিনেটেড বন্ডের সুদহার ছিল অনেক বেশি। সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে এ বন্ডের সুদহার বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দেয়, যা ৭ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে থাকে। তাছাড়া সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যু বা ওই বন্ডে বিনিয়োগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত অন্যান্য নিয়ম-নীতি পরিপালন করতে হয়। এ বন্ডের মেয়াদ সাধারণত পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে হয়।

ব্যাংকের মূলধনের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় এমন আরো একটি বন্ড রয়েছে। বন্ডটির নাম পারপেচুয়াল বন্ড। মূলত পারপেচুয়াল শব্দটি এসেছে বন্ডের মেয়াদের কারণে। এ বন্ডের কোনো মেয়াদ হয় না। এটি বেমেয়াদি বন্ড। যেহেতু বন্ডটি ইস্যু করলে তা মূলধনের অংশ হয়, তাই অনেকগুলো ব্যাংক এ বন্ড ইস্যুর বিষয়ে দুই বছর ধরে কাজ করছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমোদনও পেয়েছে কয়েকটি বন্ড। সাধারণত পারপেচুয়াল বন্ড স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে বিক্রি করে রি-পেমেন্ট (বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত) হওয়ার কথা। এছাড়া বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরতের আর কোনো উপায় না থাকায় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে এ বন্ড এখনো তেমন জনপ্রিয় হয়নি। অবশ্য ব্যাংক ছাড়া অন্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানও পারপেচুয়াল বন্ড ইস্যু করতে পারে।

ব্যাংক ব্যতীত অন্যান্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানও তাদের প্রয়োজনে বন্ড ইস্যু করতে পারে। এ রকম বন্ডকে বলা হয় করপোরেট বন্ড। এ বন্ড ইস্যুর জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি দ্বারা বন্ডের রেটিং করাতে হয়। ভালো রেটিং না হলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বন্ডের অনুমোদন দেয় না। সাধারণত এ বন্ডের সুদহার বিদ্যমান অন্য বন্ডগুলোর সুদহার অপেক্ষা বেশি হয়। করপোরেট বন্ডে বিনিয়োগে তেমন কোনো জামানত থাকে না। তবে মাঝে মাঝে ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের ব্যক্তিগত গ্যারান্টি, প্রতিষ্ঠানের করপোরেট গ্যারান্টি ইত্যাদি জামানত হিসেবে ব্যবহূত হয়।

সরকারি সুকুক বন্ডের ন্যায় সম্প্রতি চালু হয়েছে বেসরকারি সুকুক বন্ড। বেসরকারি সুকুক বন্ডের বেশির ভাগ বৈশিষ্ট্য সরকারি সুকুক বন্ডের মতো হলেও এটি এসএলআরে উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয় না। বেসরকারি সুকুক বন্ডের সুদহার সরকারি সুকুক বন্ডের সুদহারের চেয়ে বেশি হয়।

রফতানি আয়ের পর বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার বৃহৎ একটি উৎস হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। সরকার রেমিট্যান্স থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে দেশের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করে। আমদানি ও রফতানি থেকে সৃষ্ট আয় ব্যয়ের চেয়ে বেশি হলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের রিজার্ভ আকারে জমা হয়। আর উল্টোটা হলে রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করতে হয়। এজন্য একটি দেশের রিজার্ভ যত বেশি, সেই দেশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে ততটা শক্তিশালী মনে করা হয়।

দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদানের কথা বিবেচনা করে সরকার শুধু প্রবাসীদের জন্য ইস্যু করে ওয়েজ আর্নার্স বন্ড। এ বন্ডের সুদহার দেশের বাজারে প্রাপ্ত সব বন্ডের সুদহারের চেয়ে বেশি। ওয়েজ আর্নার্স বন্ডে বিনিয়োগে বিনিয়োগকারীকে সাধারণ সব তথ্যের পাশাপাশি পাসপোর্টের কপি, ভিসার কপি, চাকরি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দিতে হয়।

যেকোনো প্রতিষ্ঠানে অর্থায়নের মূল উৎস দুটি। একটি হলো ঋণ, আর অন্যটি মূলধন। বিশ্বব্যাপী মূলধন উত্তোলনের প্রাথমিক উৎস হলো উদ্যোক্তারা, আর মূলধন বৃদ্ধির ব্যাপক প্রচলিত উৎস হলো স্টক এক্সচেঞ্জ বা শেয়ারবাজার। অন্যদিকে ঋণ গ্রহণের জন্য প্রাথমিক উৎস হলো ব্যাংক খাত এবং প্রয়োজনীয় ঋণের ব্যাপক প্রচলিত উৎস হলো বন্ড মার্কেট।

আমরা যে কেউ চাইলেই একটি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স হিসাব খুলে যেকোনো সময় তালিকাভুক্ত যেকোনো শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারি। কিন্তু বন্ডের পর্যাপ্ত বাজার অবকাঠামো না থাকায় বিনিয়োগ করতে পারি না। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ইস্যুকৃত সরকারি সব বন্ড ও সব প্রকার বেসরকারি বন্ড স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে খোলাবাজারে বিক্রি শুরু না করলে কখনই কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কার্যকর বন্ড মার্কেট গঠনের মাধ্যমে দেশের বর্তমান অর্থনীতি আরো এক ধাপ এগিয়ে নেয়া সম্ভব।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top