ভ্রমণ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ মালিক। সাম্প্রতি তিনি সেই ভ্রমণের আদ্যপ্রান্ত তুলে ধরেন। শ্রুতি লিখেছেন- শাহীনুর ইসলাম।
(বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর আমি প্রায় ৪০টি দেশ ভ্রমণ করেছি। সব দেশের মধ্যে সেরা এবং সৌন্দর্যের স্থান দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন। যাকে সৌন্দর্যের রানি বললেও কম বলা হবে। প্রায় ৫ বছর আগে অপরূপ এই ভূস্বর্গ ভ্রমণ করি এবং যা এখনো আকর্ষণ করে)
তখন কেপটাউনে চলছিল গ্রীষ্মকাল। আমাদের এখানে শীতকাল। সে সময় পরিবারসহ দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়েস্টার্ন কেপের ছোট্ট এক দ্বীপ রবেন আইল্যান্ড ভ্রমণে যাই। চারদিকে ছবির মতো ঝকঝকে পরিষ্কার। কদিন আগে শীতের যে তীব্রতা বয়ে গেছে তা খড়কুটো দেখেই বোঝা যায়। বরফ জমে না থাকলেও সেই চিহ্ন রয়েছে।
পাহাড়ের সমতল চূড়া। তার ওপর দাঁড়ালে দেখা মেলে একদিকে শুভ্রতায় ঘেরা পাহাড়, তার গা ঘেঁষে সমূদ্র। তবে সমুদ্রের দুদিকের পানি দুই রকমের, রঙে মেলে না।
পৃথিবীর মানুষের কাছে যখন দ্বীপটি পরিচিত হয়ে ওঠে তখন তাকে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। প্রথমদিকে কৃষিকাজে ব্যবহৃত হলেও পরে দ্বীপটি ক্রীতদাসদের জন্য নির্ধারিত হয়। বিভিন্ন সময়ে রবেন দ্বীপকে নির্বাসন, কুষ্ঠরোগীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা এবং রাজনীতিক বন্দীদের এখানে রাখা হতো।
কেন এখানে বন্দীদের রাখা হতো? তা বলে নেয়া ভালো- আয়তনে ছোট এবং ডিম্বাকৃতির দ্বীপটি লম্বায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ২ কিলোমিটার। প্রাচীন যুগে দ্বীপটি মূলত পর্বতের প্রান্ত হিসেবে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সবশেষ বরফ যুগের প্রায় ১২ হাজার বছর আগে ক্রমবর্ধমান সমুদ্রস্তর উপকূল থেকে এ দ্বীপকে পৃথক করে। মূল জনপদ ও সমতল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় স্বর্গীয় এই ভূমিতে বন্দীদের রাখা হতো।
১৯৬১ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার রাজনৈতিক বন্দী এবং সাজাপ্রাপ্তদের নির্বাসনের জন্য দ্বীপটিকে নির্বাচিত করে। রবেন দ্বীপের প্রথম বন্দী ছিল স্ট্র্যান্ডলপার নেতা অতশুমাতো। ঊনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে আফ্রিকান নেতারা এ দ্বীপে নির্বাসিত হন। আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ আঠারো বছর (১৯৬৪ থেকে ১৯৮২) এ নির্জন দ্বীপে কারাবন্দি থেকেছেন।
রবেন দ্বীপ নির্জন হলেও প্রাণীশূন্য নয়। এখানে চারদিক সুনসান নীরবতা। শুধু শোনা যায় সাগরের ঢেউ ছুঁয়ে শনশন বাতাসের শব্দ। অমাবস্যার রাতে দ্বীপটি যেন আঁধারপুরী! চারপাশে ভিন্ন কিছু প্রাণীর দেখাও মেলে। গ্রীষ্মকাল হলেও পেঙ্গুইন ঠিক ভদ্রলোকের মতো আপনার পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে। আরও দেখা যায় প্রাচীন কিছু কচ্ছপ।
স্থানীয় মানুষের সংখ্যা তেমন নেই। তবে পর্যটন অনেক বেশি। বাঙালি বা বাংলাদেশির সংখ্যাও এখানে অনেক। তারা অনেকে ব্যবসা করছেন। অনেক ভাষাভাষী মানুষ হলেও সবার দৃষ্টি শুধু পানি, পাহাড় আর পেঙ্গুইনের চলায় মুগ্ধ।
এখানে রয়েছে প্রচুর সামুদ্রিক প্রাণী সিল। দৃষ্টিনন্দন দ্বীপটি ‘সিল দ্বীপ’ নামেও পরিচিত। দ্বীপটির খ্যাতি তার কারাগারের জন্যই। প্রতিদিন পৃথিবীর অসংখ্য পর্যটক নৌযানে করে রবেন দ্বীপে ঘুরতে আসেন। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণ হলো নেলসন ম্যান্ডেলার বন্দিশালা। আমরাও গিয়েছিলাম।
কিছু অনুভূতি বা মুগ্ধতা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কিছু সৌন্দর্য যেন চোখে লেগেই থাকে। সেই লেগে থাকা বা চোখের ভেতরে জেগে থাকা সৌন্দর্য কেপটাউন।
পুরো দ্বীপটি পর্যটকদের বাসে করে ঘুরিয়ে দেখানো হয়। দেখানো হয় কারাগারে থাকা বিভিন্ন বন্দীদের দলিল ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং ঐতিহাসিক স্থান। দ্বীপটি এখন নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে উঠেছে। পর্যটকরা সহজেই রবেন দ্বীপ ভ্রমণ করতে পারেন, কারাগারে যেতে পারেন এবং বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন।
এখানে গাড়িতে করে ঘুরে বন্যপ্রাণী দেখতে গিয়ে বিপদের মুখেও পড়েছিলাম। গাড়িতে আমরা যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল দুটি হাতি। তারা একে অপরকে তাড়া করছে। আমাদের গাড়ি দেখে হঠাৎ তারা এদিকে তেড়ে আসে। আমরা ভয়ে অস্থির। গাইড জানালেন, এমনটা তারা কখনো করে না। যদি করে তা অনেক বড় বিপদ বয়ে আনে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি পেছনে সরিয়ে নিলেন। হাতি এগিয়ে আসতে শুরু করলে ড্রাইভার দক্ষতার সাথে গাড়ি আরো দ্রুত সরিয়ে নিলেন। আমরা বেঁচে গেলাম।
এখানে রয়েছে টেবিল পর্বত। এটি শহরের প্রতীকী পর্বত, টেবিল মাউন্টেন জাতীয় উদ্যানের অভ্যন্তরে সমতল শীর্ষে একটি পর্বত। ২০১১ সাল থেকে এটি অন্যতম বিশ্বের ৭টি প্রাকৃতিক আশ্চর্যের একটি। শীর্ষে মালভূমির দৈর্ঘ্য প্রায় দুই মাইল। সম্মুখভাগ যেন সিংহের মাথা এবং এর একদিকে শয়তানের শৃঙ্গ, নিচে খাঁড়া শৃঙ্গ বেয়ে চলা জলরাশি। পৃথিবীর সেরা সৌন্দর্য এখান থেকেই অবলোকন করেন পর্যটকরা।
যার সৌন্দর্যের উদাহরণ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। মানুষ এখানে এলে কথা বলে কম। মুগ্ধ হয়ে শুধু চেয়ে থাকে।
এখানে রয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা হেঁটে যাওয়ার পথ। ইউরোপ, আফ্রিকা আর এশিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি আর মানুষের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় একটি রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আপনি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন থেকে রাশিয়ার মাগাদানে যেতে পারবেন। বিমান, ট্রেন, বাস কিংবা লঞ্চ, কোনো যানবাহনেই আপনাকে উঠতে হবে না। এই রাস্তা ২২ হাজার ৩৮৭ কিলোমিটার লম্বা।
প্রতিদিন যদি ৮ ঘণ্টা করে হাঁটেন তবে ৫৮৭ দিন লাগবে আপনার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রাশিয়া পৌঁছাতে। ১৯৪ দিন হাঁটা লাগবে যদি কোনো বিরতি ছাড়া হেঁটে চলেন।
কোনো বাধা ছাড়াই হেঁটে রাশিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রাশিয়া যাওয়া সম্ভব। যাত্রাপথে পড়বে অন্তত ১৭টি দেশ। ৬টি টাইম জোন। যে এই রাস্তা ধরে হাঁটবেন, সে কয়েকটি ঋতু পরিবর্তনও দেখতে পাবেন। যাত্রাপথে পাবেন অনেক আবহাওয়া। এই যাত্রাপথ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হেঁটে চলার রাস্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যা মাউন্ট এভারেস্টে ১৩ বার উঠানামা করলে এই রাস্তার হেঁটে চলা পথের সমান হবে।
কেপটাউন এটি দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বাধিক বিখ্যাত শহর। অনুমান করা হয় প্রতি বছর দুই মিলিয়ন পর্যটক এখানে পরিদর্শন করতে আসেন। এটি এমন একটি শহর যেখানে আপনি ট্যাক্সি, সাইকেল, মিনি বাস, বাস বা ট্রেনে চলাচল করতে পারেন।
পর্যটক মুগ্ধ করতে রয়েছে নব রকমের ব্যবস্থা। শহরজুড়ে হোটেল এবং মোটেল বেশি হওয়ায় অল্প ব্যয়ে রয়েছে থাকা এবং খাওয়ার সুব্যবস্থা।
তবে শেষের কথা হলো- আপনি যেখানেই যান, কিছু লোক আপনাকে ঠকানোর জন্য ওৎ পেতে বসে থাকবে। তাদের থেকে সাবধান এবং সচেতন থাকবেন। আপন মানুষ ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করবেন না।