সকল মেনু

রাশিয়ার গ্যাস বর্জন করতে গিয়ে দিশেহারা ইউরোপ

ডেস্ক রিপোর্ট: ইউরোপ অতিরিক্ত ৫ হাজার কোটি ঘনফুট গ্যাস কিনতে চাইলেও, বিশ্ববাজারে সরবরাহের পরিমাণ সীমাবদ্ধ। সে তুলনায় বাড়তি চাহিদার কারণে মূল্য আরো বাড়বে, বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশের ভাগের সরবরাহ হয়তো তাতে কমতে চলেছে। পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যা হবে এক অশনি সংকেত

মাস খানেক আগেই জাহাজে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) চালান আনলোডে একটি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল ইউরোপের অর্থনৈতিক পরাশক্তি জার্মানি। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো এটির পূর্ণ-সক্ষমতা ব্যবহার করবে কিনা- তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন এর নির্মাতারা।

কারণ এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণে দরকার হয় শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ। তারপর সক্ষমতার একটি বড় অংশ অব্যবহৃত থাকা মানে ব্যবসার ক্ষতি। আরও ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ইউরোপের প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। অর্থাৎ, দীর্ঘমেয়াদে লাভক্ষতির সমীকরণ।

কিন্তু, রাতারাতি যেন সেসব ধ্যানধারণা বদলে গেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধাভিযান এবং জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে ক্রেমলিনের দেওয়া হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে জার্মান সরকার এখন এ ধরনের চারটি সুবিশাল স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পদক্ষেপটির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি আমদানি বাড়িয়ে কমানো যাবে- রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা। সেই পরিকল্পনা নিয়েই মস্কোর ‘জ্বালানি ফাঁদ’ এড়াতে সচেষ্ট বার্লিন। এই মুহূর্তে করদাতাদের অর্থে সুবিশাল বিনিয়োগ নিয়েও তাই দ্বিরুক্তি নেই জার্মানির।

ইউরোপে মোট ব্যবহৃত প্রধান জ্বালানি পণ্যের এক-পঞ্চমাংশ হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। মহাদেশের ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস পুড়িয়ে। শীতকালে ঘর উষ্ণ রাখতে গ্যাস চালিত হিটারসহ শিল্প উৎপাদনেও লাগে জ্বালানিটি।

ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের বৃহত্তম সরবরাহক রাশিয়া। মহাদেশটির ৪০ শতাংশ চাহিদা মেটায় রাশিয়া থেকে পাইপলাইনে আসা গ্যাস। পাইপলাইনে গ্যাস রপ্তানিতে তারপর আছে নরওয়ে (২২%), আলজেরিয়া (১৮%) এবং আজারবাইজান (৯%)। এছাড়া, জাহাজে করে এলএনজি-ও আমদানি করতে হয় ইউরোপকে।

রাশিয়া থেকে বেশিরভাগ গ্যাস আসে পাইপলাইনে, আর তাতে এলএনজিকরণের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু, স্থলসীমানা নেই এমন মহাদেশ থেকে গ্যাস আনতে তরলীকরণ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এভাবে দূরদূরান্ত থেকে ট্যাংকার জাহাজে এলএনজি এনে, আনলোডিং টার্মিনালের রিগ্যাসিফিকেশন প্ল্যান্টে তা পুনরায় গ্যাসে রুপান্তর করে পাইপলাইনে করে সরবরহ করা হয়।

জার্মানি এখন অন্যান্য উৎস থেকে দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ব্যতিব্যস্ত। সম্ভাব্য সরবরাহক দেশের সাথে আলোচনার আগে জার্মানির অর্থনীতি- বিষয়ক মন্ত্রী রবার্ট হাবেক বলেছেন, “আমরা জার্মানিতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের লক্ষ্য নিয়েছি।”

অথচ জার্মানির পরিবেশবাদী গ্রিন দল থেকে নির্বাচিত সাংসদ হাবেক। কিন্তু, তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য জার্মানির এখন জীবাশ্ম জ্বালানির বিপুল যোগান দরকার।

গত শনিবার ইউরোপের আরেক দেশ লিথুনিয়া রাশিয়া থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ করেছে। লিথুনিয়া ছোট দেশ হওয়ায় এতে রাশিয়ার রপ্তানি আয়ে সামান্য আঁচড় পড়বে না। কিন্তু, ইউরোপিয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য হওয়ায় এ সিদ্ধান্তের ভূ-রাজনৈতিক প্রতীকী মর্যাদা রয়েছে। এতে ইইউ- এর বড় ক্রেতা দেশগুলো রাশিয়ার গ্যাস কেনা বন্ধ করার এক চাপের মুখে পড়লো।

গত সোমবার ইউক্রেনের একটি সড়কে বেসামরিক নাগরিকদের মৃতদেহ পড়ে থাকার দৃশ্য বিশ্ববাসীর নজরে আনে পশ্চিমা গণমাধ্যম। কিয়েভ সরকার ও তাদের দাবি, এটি রুশ সেনাদের গণহত্যার প্রমাণ। আর তাতে রাশিয়ার গ্যাস বর্জনের চাপ আরো বেড়েছে ইইউয়ে। যথেষ্ট মজুদ বা সরবরাহ নিশ্চিতের আগে তাড়াহুড়ো করে রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে গিয়ে ইউরোপের জন্য অতি-দরকারি জ্বালানির চালান হারাতে চান না ইইউ সরকার প্রধানেরা।

এ মনোভাব অবশ্য দ্রুত বদলাচ্ছে। মহাদেশটির সবচেয়ে বড় অর্থনীতি জার্মানিসহ অন্য দেশগুলো যত দ্রুত সম্ভব বিকল্প উৎস থেকে আমদানি বাড়াতে উৎসুক। তাদের কারণে তেল ও গ্যাসের বিশ্ববাজার আরো চড়া। পুনঃরূপ পাচ্ছে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে সরবরাহ-যোগানের কাঠামো ।

অনেক বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ঘর উষ্ণ রাখতে রাশিয়া থেকে বিপুল গ্যাস আমদানি করেছে ইউরোপ। এজন্য শত শত কোটি ডলারে পাইপলাইন স্থাপন করেছে, এখন সেগুলিই বর্জনের ঝুঁকিতে। অনেক প্রতিষ্ঠান কমিয়েছে পাইপলাইনের গ্যাস কেনাও।

ইইউ রাশিয়ার ওপর নির্ভরতাকে তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর ভাবছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই মস্কোর কথিত ‘নাগপাশ’ কাটাতে উদ্যমী। রয়েছে মাত্র এক বছরের মধ্যে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পরিকল্পনা। বর্তমানে ৪০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ রাশিয়া থেকে কিনলেও, ১২ মাসের ব্যবধানে তা দুই-তৃতীয়াংশ কমাতে চাইছে।

এই লক্ষ্যমাত্রা বিস্ময়কর। প্রশ্ন হলো- এত বিপুল রাশিয়ান গ্যাস কী অন্য উৎস থেকে প্রতিস্থাপন সম্ভব? ইউরোপ মনে করছে, চেষ্টায় ক্ষতি নেই। আর সেজন্য বাজি ধরেছে এলএনজির চালানে।

ইইউ নেতৃবৃন্দ আগামী বছর জুড়ে বাড়তি পাঁচ হাজার কোটি ঘনমিটার এলএনজি চালান কিনতে চান। এই সরবরাহ পেলে যে পরিমাণ রাশিয়ান গ্যাস তারা বর্জন করতে চায়, তার অর্ধেক চাহিদা পূরণ হবে। তবে এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, ইউরোপিয় কর্মকর্তারা নরওয়ে ও আজারবাইজান থেকেই পাইপলাইনে গ্যাস কেনার পরিকল্পনা করছেন। চলছে সাশ্রয়ী হওয়ার চেষ্টা। সেজন্য সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য প্রকল্পগুলো জোর পাচ্ছে। জনগণকেও পরিমিত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে সরকার পক্ষ।

বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, রাশিয়ার বেশিরভাগ গ্যাস বর্জন সহজ হবে না, আর অন্য উৎস থেকে পূরণে হিমশিম-ই খাবে ইউরোপ। আর ঠিক একারণেই রেশনিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে জার্মানি।

তাছাড়া, বাড়তি এই গ্যাস এলএনজি আকারে কিনতে বর্তমান বাজারদরে খরচ পড়বে ৫ হাজার কোটি ডলার। আমেরিকা থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কিনলে খরচ পড়বে অনেকটাই কম, কারণ মার্কিন বাজারে দাম ইউরোপ ও এশিয়ার উচ্চ দরের ভগ্নাংশ মাত্র।

জ্বালানির বিশ্ববাজারে এখন আগুন। সবাই ছুটছে আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দ্বারে দ্বারে। ইউরোপের বাড়তি যোগান পাওয়ার চেষ্টার কারণে তেল-গ্যাস চালান পাওয়ার এ লড়াই তুমুল রূপ নিবে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারের বর্তমান অবস্থায় নেই অতিরিক্ত যোগানের সুযোগ। ফলে চীন, জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশিয়ার বড় ক্রেতাদের সাথে এখন ইইউ দেশগুলোকে দর প্রতিযোগিতায় নামতে হবে।

ইউরোপের কারণে বিশ্ববাজারে আরো ১০ শতাংশ চাহিদা বাড়বে গ্যাসের। ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে জ্বালানি কেনা নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হতে চলেছে। হবে সম্পর্কের অবনতি। এর অর্থ, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছে যাওয়া গ্যাসের দর উচ্চ অবস্থানেই থাকবে। আর তাতে দুর্দশা বাড়বে শুধু সাধারণ ভোক্তাদের, ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিল্পোৎপাদন, ব্যাহত হবে অর্থনৈতিক বিকাশ।

  • সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top