সকল মেনু

৬,০০০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারী

সিনিয়র রিপোর্টার : চলতি বছরের প্রথম চার মাসে শেয়ারবাজার থেকে বৈদেশিক বিনিয়োগের বহিঃপ্রবাহ ছিল ১ হাজার কোটি টাকা, আর অন্তঃপ্রবাহ ছিল মাত্র ৩০০ কোটি টাকা। গত বছর বৈদেশিক বিনিয়োগের বহিঃপ্রবাহ ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা, যেখানে অন্তঃপ্রবাহ ছিল ২ হাজার কোটি টাকা।

মুদ্রার অবমূল্যায়নের ডলারের বিপরীতে দুর্বল হয়ে পড়েছে টাকা। এতে পুঁজিবাজারে কমে যাচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মুনাফা। ফলে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের পোর্টফোলিও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ব্যাপকভাবে।

বিদেশি বিনিয়োগের পোর্টফোলিওর শেয়ার বিক্রির ফলে চাপের মুখে পড়েছে শেয়ারবাজার, নিম্নগামী হয়ে আছে মূল্য সূচকগুলো।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে শেয়ারবাজার থেকে বৈদেশিক বিনিয়োগের বহিঃপ্রবাহ ছিল ১ হাজার কোটি টাকা, আর অন্তঃপ্রবাহ ছিল মাত্র ৩০০ কোটি টাকা। গত বছর বৈদেশিক বিনিয়োগের বহিঃপ্রবাহ ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা, যেখানে অন্তঃপ্রবাহ ছিল ২ হাজার কোটি টাকা।

ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয় এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের মন্দার মধ্যে অর্থনীতিকে কিছুটা সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের আগস্টে টাকার অবমূল্যায়ন শুরু করে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী ডলারের মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে মুদ্রা বিনিময় হারের সম্ভাব্য সংশোধনের লোকসান এড়াতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বছরের শুরু থেকে শেয়ার বিক্রি শুরু করে।

গত বছরের জানুয়ারিতে ডলারের আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার ছিল ৮৪.৮০ টাকা। অর্থাৎ একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী ওই মূল্যে বিক্রি করা প্রতিটি শেয়ারের জন্য এক ডলার পাবেন।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রমাগত টাকার অবমূল্যায়নের পর আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার গিয়ে থেকেছে ৯২.৮০ টাকায়। অর্থাৎ এখন ৮৪.৮০ টাকায় একটি শেয়ার বিক্রি করলেও একজন বিনিয়োগকারী এখন এক ডলারেরও কম পাবে।

টাকার অবমূল্যায়নের ফলে এভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এখন স্থানীয় মুদ্রাকে ডলারে রূপান্তরিত করার পর শেয়ার বিক্রির অর্থ ফেরত নিতে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে তাদের।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবমূল্যায়নের কারণে শেয়ারের রিটার্নের হারও এই ক্ষতি পোষাতে পারেনি। ফলে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও বিশ্ববাজারে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার মধ্যে স্টক মার্কেটে মূল্যসূচক নিম্নগামীই রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ অর্থবছর শেষে নেট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ঋণাত্মক ২৬৯ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ২০২০ অর্থবছরে যা ছিল ধনাত্মক ৪৪ মিলিয়ন ডলার।

ঋণাত্মক নেট অবস্থানের মানে হলো, অন্তঃপ্রবাহের চেয়ে বহিঃপ্রবাহ বেশি ছিল।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, টাকার অবমূল্যায়ন ছাড়াও বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধরে রাখতে নিরুৎসাহিত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো মার্কিন বাজারে সুদের হার বৃদ্ধি।

তিনি বলেন, টাকার অবমূল্যায়নের সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা গত বছর থেকেই শেয়ার বিক্রি শুরু করে। কারণ রিটার্নের হারের মধ্যকার পার্থক্য তাদের প্রত্যাশিত অবচয় ক্ষতির চেয়ে বেশি ছিল না।

দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে থাকায় মুদ্রার আরও অবমূল্যায়নের ঝুঁকি রয়েছে। তাই আগামী দিনে বিদেশি বিনিয়োগ ধীর থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ড. জাহিদ হোসেন।

তিনি আরও বলেন, সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়ার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য মার্কিন ট্রেজারি বন্ড আরও লাভজনক হয়ে উঠেছে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদের হার আরও বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে উদীয়মান বাজারে বিনিয়োগের চাইতে মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগই তাদের জন্য বেশি লাভজনক।

ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সম্প্রতি তাদের মূল সুদের হার ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে। ১৯৪৪ সালের পর এটিই সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।

মার্কিন মুদ্রাস্ফীতি ৮.৬ শতাংশ ছুঁয়েছে, যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ কারণে ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ মূল সুদহার ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে এবং আসন্ন মাসগুলোতে আরও বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে।

বিদেশি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার শীর্ষ ব্রোকারেজ ব্র্যাক স্টক ব্রোকারেজের প্রধান নির্বাহী আহসানুর রহমান বলেন, টাকার অবমূল্যায়ন এবং আমেরিকায় সুদহার বৃদ্ধিসহ একাধিক কারণে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার আর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় থাকেনি।

তার ওপরে মহামারিকালে উন্নত দেশগুলো থেকে অনেক বিদেশি তহবিল আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেও বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ প্রভাবিত হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আহসানুর বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এক্সচেঞ্জ রেট মার্কেট পর্যবেক্ষণের নিরাপদ অবস্থান নিয়েছে। বিনিময় হার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত তারা সম্ভবত সক্রিয় হতে পারবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কারণে কয়েক বছর ধরে বিনিময় হার ৮৪-৮৫ টাকার মধ্যে স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চলতি বছরের জুন মাসে বিনিময় হার ৯০ টাকা অতিক্রম করে।

গত দেড় বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হয়েছে ৯.৪ শতাংশ।

বর্তমানে ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ঘাটতি ও বাজারে ডলার সংকট ডলারের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড ২৭.৫৬ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে।

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার প্রতিযোগিতামূলক রাখা হবে। অনেকের ধারণা, তার এই ঘোষণার মধ্যে টাকার আরও অবমূল্যায়নের ইঙ্গিত রয়েছে।

অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যের অস্থিরতার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

তবে প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা দিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার দেশে ও দেশের বাইরে সেমিনার ও ওয়ার্কশপ, রোড শো এবং ট্রেড শো আয়োজন ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এসব ব্যবস্থার উদ্দেশ্য সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের চিহ্নিত করা, তাদের কাছে বিদ্যমান বিনিয়োগের সুযোগগুলো তুলে ধরা, তাদের বিনিয়োগ করে আকৃষ্ট করা এবং বিনিয়োগ-সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ ত্বরান্বিত করা।’

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন দেশে একাধিক রোড শো করলেও এর প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে প্রতিফলিত হয়নি।

শেয়ারবাজারে মূল্য সূচকের গতিবিধি

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইএক্স) তথ্য অনুসারে, গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত আট মাসের ব্যবধানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রড ইনডেক্স ১৬ শতাংশ কমেছে। গত বছরের অক্টোবরে ডিএসইএক্স ৭৩০০ ছুঁয়েছিল, যা গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু বাজারে গুরুতর ডলার সংকটের মধ্যে টাকার দ্রুত অবমূল্যায়নের কারণে এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এতে পুঁজিবাজারে মার্কেটে চাপ সৃষ্টি হয় এবং মূল্য সূচক ৬১০০-তে নেমে যায়।

ওই একই সময়ে দৈনিক টার্নওভার ১,৮০০ কোটি টাকা থেকে গড়ে ৬০০ কোটি টাকায় নেমে আসে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে শেয়ার বাজারে শেয়ার বিক্রি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।

জুন মাসে ডলারপ্রতি রুপির দাম রেকর্ড সর্বনিম্ন ৭৮.২৮ রুপিতে পৌঁছার পর ভারতের স্টক মার্কেটগুলো টালমাটাল হয়ে যায়।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, এক ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রার দর যেদিন ৮৭ টাকা ডলারে থেকে, সেদিন বেঞ্চমার্ক সূচক নিফটি ও সেনসেক্স যথাক্রমে ২.৬৪ ও ২.৬৮ শতাংশ হ্রাস পায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top