Homeবিশ্ববাণিজ্যবিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দ্রুত দরপতন

বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দ্রুত দরপতন

ডেস্ক রিপোর্ট : এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের বাজার ছিল অস্থির। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। তবে বিশ্ববাজারে পণ্যটির দামে হ্রাস-বৃদ্ধির প্রভাব দেশের বাজারে সেভাবে দৃশ্যমান ছিল না। বিশ্ববাজারে টানা বৃদ্ধিতে দেশের বাজারে দাম বাড়াতে কোম্পানিগুলোর দ্রুত উদ্যোগ দেখা গেলেও কমানোর ক্ষেত্রে তা ছিল শ্লথ। এ কারণে বিশ্ববাজারে টানা দরপতন ঘটলেও দাম কমাতে সময়ক্ষেপণ করছে কোম্পানিগুলো। সর্বশেষ ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ের সিদ্ধান্তে এ চিত্র উঠে এসেছে।

করোনাকালে প্রধান দুই ভোজ্যতেল পাম অয়েল ও সয়াবিনের উৎপাদন নিয়ে সংকটে ছিল উৎপাদক দেশগুলো। বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমে যাওয়া এবং লকডাউনে পরিযায়ী ও বিদেশী শ্রমিক সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাছাড়া চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় মজুদ রাখতে বেগ পেতে হয়েছিল ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলোকে।

এতে করোনাকালে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম নিম্নমুখী ও স্থিতিশীল ছিল। মূলত সংকট শুরু হয় লকডাউন থেকে একের পর এক দেশ বেরিয়ে আসার পর। হঠাৎ চাহিদা বাড়লে চাহিদার তুলনায় মজুদ ও উৎপাদন কম থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে ভোজ্যতেলের দাম। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশগুলোয় এর প্রভাব পড়ে।

চীন, ভারতসহ বিশ্বের শীর্ষ পাম-সয়াবিন আমদানিকারক দেশগুলো শুল্কহারে ছাড় দিয়ে সংকট কিছুটা কাটিয়েও ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশে শুল্ক ছাড়ে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ না থাকায় প্রায় প্রতি মাসেই ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতিদিনই কমছে ভোজ্যতেলের দাম। তা সত্ত্বেও দাম কমানোর ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর অনীহা দৃশ্যমান হচ্ছে। যে হারে বিশ্ববাজারে দাম কমছে, সে হারে দেশের বাজারে দাম কমাতে চাইছে না কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে বড় ধরনের দরপতনে কোম্পানিগুলো মূলধন হারানোর ঝুঁকি এড়াতে সতর্কতা হিসেবে খুচরা মূল্য কমাতে চাইছে না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও খাতসংশ্লিষ্টরা।

রমজানের ঈদের আগে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো না হলেও ৫ মে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি ঘটে পণ্যটির। ওই সময় প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়। এক লিটার সয়াবিনের দরে বড় এই উল্লম্ফনে সমালোচনার মুখে পড়ে কোম্পানিগুলো। এরপর ৯ জুন পণ্যটির দাম সমন্বয় করা হয়। ওই সময় পাম অয়েলের লিটারপ্রতি দাম ১৪ টাকা কমানো হলেও সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয় ৭ টাকা। সর্বশেষ ২৬ জুন নতুন করে শুধু বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ৬ টাকা কমিয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিক দাম কমলেও দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমানোর ক্ষেত্রে এ ধীর নীতির পেছনে অতি মুনাফা অর্জনকে মূল কারণ বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ী ও খাতসংশ্লিষ্টরা।

গত এক বছরে অন্তত ১৫ দফায় ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করেছে সরকার ও আমদানিকারক কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করা হয়। দাম সমন্বয় পদ্ধতির জন্য আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর গত কয়েক মাসের ইনবাউন্ড ও আউটবাউন্ড তথ্য, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একই সময়ের ঋণপত্র তথ্য সংগ্রহ করে ট্যারিফ কমিশন ভোজ্যতেলের সমন্বয়যোগ্য দামের একটি প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পেশ করে।

প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের নতুন বাজারদর নির্ধারণ করে ঘোষণা দেয়া হয়। এক বছর ধরে ভোজ্যতেলের বৈশ্বিক দাম প্রতিদিনই ওঠানামা করায় ব্যবসায়ীরাও দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন দাম নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু দেড় মাস ধরে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম টানা কমলেও দাম কমানোর ক্ষেত্রে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন একটা উদ্যোগী হয়নি।

বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র এজিএম তাসনিম শাহরিয়ার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ভোজ্যতেলের দাম যেভাবে কমছে তাতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। এক মাস আগে যে ভোজ্যতেল কেনা হয়েছে, তা দেশে আসার আগেই কয়েক দফায় দরপতনে কয়েকশ ডলার কমে গেছে। এ কারণে ভোক্তারাও দাম কমে যাওয়ার প্রকৃত সুফল পাচ্ছে না।

কোম্পানিগুলোর সুরক্ষা কিংবা বড় লোকসানের ঝুঁকি এড়াতে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর দাম পুনর্নির্ধারণ করতে হচ্ছে। ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের এ উভয়মুখী সংকট দূর করতে দ্রুত সময়ের মধ্যে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করার মাধ্যমে বিশ্ববাজারে পতনমুখী সময়ে ক্রয় করা পণ্য বিক্রি করে দেয়ার সুযোগ থাকবে বলে মনে করছেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের প্রধান প্রধান কমোডিটি এক্সচেঞ্জে ভোজ্যতেলের ফিউচার মার্কেটও নিম্নমুখী রয়েছে। ভোজ্যতেল উৎপাদনের নতুন মৌসুম শুরু হলে বাড়তি উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমছে। গত ২৮ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিলেও নিজ দেশের কৃষকদের দাবির মুখে রফতানি উন্মুক্ত করতে বাধ্য হয় দেশটির সরকার। মূলত ইন্দোনেশিয়ার রফতানি শুরুর ঘোষণা বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের ঊর্ধ্বমুখী বাজারে দরপতনের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন তারা।

গত ৪ মে লিটারপ্রতি খোলা সয়াবিনের দাম বাড়িয়ে ১৮০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন ১৯৮ টাকা এবং সুপার পাম অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ১৭২ টাকা করা হয়। ৯ জুনের ঘোষণায় কোম্পানিগুলো এক লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে ১৮৫ টাকা, বোতলজাত সয়াবিনের দাম ৭ টাকা বাড়িয়ে লিটারপ্রতি ২০৫ টাকা করলেও পাম অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ১৪ টাকা কমিয়ে ১৫৮ টাকা করা হয়। সর্বশেষ গতকাল (২৬ জুন) বাণিজ্য সচিবের আভাস দেয়ার পর শুধু বোতলজাত সয়াবিনের লিটারপ্রতি দাম ৬ টাকা কমিয়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৯৯ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ ৯ জুনের দাম ঘোষণায় সয়াবিনের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৭ টাকা বাড়ানো হলেও ১৮ দিনের ব্যবধানে দাম ৬ টাকা কমানো হয়েছে।

টনপ্রতি কয়েকশ ডলার কমার পর সর্বশেষ ১১ জুন বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৩৬০ ডলার। এরপর ২২ জুন দাম নেমে আসে ১ হাজার ২৭১ ডলারে এবং সর্বশেষ ২৬ জুন লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে ১ হাজার ২৪৫ ডলারে। অন্যদিকে ১১ জুন সয়াবিনের দাম ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৭৮১ ডলার। ২২ জুন অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম নেমে আসে ১ হাজার ৬১৭ ডলারে। চারদিনের ব্যবধানে ২৬ জুন শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে সয়াবিনের বুকিং আরো ৮০ ডলার কমে লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে ১ হাজার ৫৩৭ ডলারে।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, মে মাসে বিশ্ববাজারে পাম অয়েলের মাসভিত্তিক গড় বুকিং ছিল ১ হাজার ৭১৭ ডলার। আর একই মাসে সয়াবিনের মাসভিত্তিক গড় বুকিং ছিল ১ হাজার ৯৬৩ ডলার। ২৬ জুন পর্যন্ত পাম অয়েলের দাম কমেছে ৪৭২ ডলার এবং একই সময়ে সয়াবিনের দাম কমেছে ৪২৬ ডলার।

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, রোববার পাইকারি পর্যায়ে মণপ্রতি পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ৬ হাজার ৩০০ টাকায় (মিল থেকে সরাসরি উত্তোলনযোগ্য)। সয়াবিন বিক্রি হয়েছে মণপ্রতি ৭ হাজার ৫০০ টাকায়। ৯ জুনের দর সংশোধনের পর খোলা পর্যায়ে পাম অয়েলের দাম কমলেও সয়াবিনের দাম দুই মাস আগের সর্বোচ্চ দামে লেনদেন হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখে কোম্পানিগুলো ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা করেছিল। পরবর্তী সময়ে কোম্পানিগুলো সয়াবিনের দাম আরো ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৮০ টাকা করার প্রস্তাব দিলেও রমজান মাস সামনে রেখে বাজার অস্থিরতা দূর করতে ভ্যাট কমিয়ে দেয়া হয়। পরে ২০ মার্চ দাম লিটারপ্রতি ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, দেশে ভোজ্যতেলের বাজার মুষ্টিমেয় কয়েকটি কোম্পানির হাতে চলে গিয়েছে। আগের বেশকিছু কোম্পানি ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়ার কারণে মার্কেট থেকে সরে গিয়েছে। শীর্ষ কয়েকটি কোম্পানির ওপর একক নির্ভরশীলতার কারণে বিশ্ববাজারে যে দামই থাকুক না কেন কোম্পানিগুলোর মুনাফা নিশ্চিত করেই দাম নির্ধারণ করা হয়।

প্রতিযোগিতা কমিশনসহ সরকারি সংস্থাগুলোকে সক্রিয় করে তদারকি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও পরিধি বাড়ানো না গেলে অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে ভোজ্যতেলের বাজারে থেকে অতি মুনাফার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না বলে মনে করছেন তিনি।

যদিও ব্যবসায়ীদের দাবি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে সয়াবিন আমদানি করতে ন্যূনতম ৪৫-৫০ দিন সময় লাগে। ফলে এখন দাম কমলেও এসব সয়াবিন দেশে এনে বিপণন পর্যায়ে নিয়ে যেতে সময় লাগবে। সেজন্য এখনো কাঙ্ক্ষিত দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না। চলতি মাসের বুকিং দেয়া সয়াবিনের দর সমন্বয় হতে পারে আগামী মাসে।

তবে সয়াবিনের ক্ষেত্রে আমদানি ঋণপত্র খোলা ও বিপণনে সময়ক্ষেপণের কথা বলা হলেও ইন্দোনেশিয়া কিংবা মালয়েশিয়া থেকে পাম অয়েল আমদানি করতে ১৫-২০ দিন সময় প্রয়োজন হয়। ফলে চলতি মাসের শুরুর দিকে বুকিং দেয়া পাম অয়েল এরই মধ্যে বাংলাদেশে এসে পরিশোধন কার্যক্রম ও বিপণন শুরু হলেও ২৬ জুনের সংশোধিত দরে পাম অয়েলের দাম কমানো হয়নি। ৯ জুন পাম অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ১৪ টাকা কমানোর কারণে সর্বশেষ সংশোধনে পাম অয়েলের দর সমন্বয় করা হয়নি বলে দাবি করেছেন আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিরা।

  • তথ্য সূত্র : বণিক বার্তা
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাত দিনের সর্বাধিক পঠিত