Homeঅনুসন্ধানী প্রতিবেদনহিরো সিন্ডিকেটের কারসাজির নমুনা

হিরো সিন্ডিকেটের কারসাজির নমুনা

ডেস্ক রিপোর্ট: আর যাই হোক, একা একা শেয়ার কারসাজি হয় না। তার জন্য দরকার বড় সিন্ডিকেট, আর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। হিরো বিশাল এক সিন্ডিকেট গড়েছেন। আর তাঁর টাকার সাপ্লাই দিয়েছে বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস। গত বছরের জুনে এ প্রতিবেদকের কাছে হিরোর স্বীকারোক্তি ছিল এমন- ‘শুধু নিজের টাকায় শেয়ার ব্যবসা হয় না। ব্যাংকের সাপোর্ট না থাকলে, কারও পক্ষেই শেয়ার নিয়ে খেলা সম্ভব নয়’।

হিরো শেয়ার কারসাজির পাঠ নিয়েছেন শেয়ারবাজারে তাঁর দীর্ঘ ১৬ বছরের ব্যবসার অভিজ্ঞতা থেকে। সেই ২০০৬ সালে উচ্চ শিক্ষা নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছিলেন তিনি, তখন থেকে শেয়ার কেনাবেচায় যুক্ত হন। গত ১৬ বছরে একটু একটু এ বাজারের কানাগলিগুলোর সবটাই চিনেছেন তিনি। এই চেনাজানা থেকেই শেয়ার কারসাজিতে বাজিমাত করতে সিন্ডিকেটে যুক্ত করেছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে হিরো ৬৮ কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করছেন। এর মধ্যে সমকালের অনুসন্ধানে দুই ডজনের বেশি শেয়ারে বড় ধরনের কারসাজি করেছেন। হিরো ও তাঁর সিন্ডিকেট সদস্যদের শতাধিক অ্যাকাউন্টের মধ্য থেকে তাঁর নিজের, পরিবার সদস্য ও স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নয়টি এবং মূল সিন্ডিকেটের ১২টিসহ মোট ২১টি অ্যাকাউন্টের লেনদেন পর্যালোচনায় এ তথ্য মিলেছে।

গত বছরের ৪ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত এক মাসে ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর এক মাসেই ৪১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সায় ওঠে। হিরোর নিজের এবং স্ত্রীর অ্যাকাউন্ট থেকে নিজেরা শেয়ার কেনাবেচা করে এ দর বাড়ানোর নেপথ্যে ছিলেন। তাঁর কারসাজির সম্পৃক্ততা তুলে ধরতে গিয়ে ডিএসই এক দিনের দরের উত্থান কী করে হলো, তা উল্লেখ করতে গিয়ে এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২১ সালের ২১ এপ্রিল ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের ৬৮১টি হাওলায় (ট্রেড) মোট ১১ লাখ ২০ হাজার ৯০৭টি শেয়ার কেনাবেচা হয়।

এর মধ্যে হিরো এবং তাঁর স্ত্রী সাদিয়া ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজ, এসবিএল ক্যাপিটাল ও অগ্রণী ইক্যুয়িটি থেকে নিজেরা ৩৩৫টি ট্রেডে ৭ লাখ ২৪ হাজার ৩৪৩টি শেয়ার কেনাবেচা করেন। ওই দিন ডিএসইতে ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার লেনদেন শুরু হয় ৫১ টাকা ৭০ পয়সায়। হিরো তাঁর নিজের ও স্ত্রীর বিও অ্যাকাউন্টে সিরিজ লেনদেন শুরু করেন সকাল ১০টা ১৪ মিনিটে। তাঁদের দু’জনের চার অ্যাকাউন্ট থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত শেয়ার কেনাবেচা করে ৫৬ টাকা ৮০ পয়সায় দর তোলেন।

আবার ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ অক্টোবর, অর্থাৎ দেড় মাসে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর দ্বিগুণ হয় (১৩৭ টাকা থেকে ২২৬ টাকা)। মাত্র দেড় মাসে ডেল্টার শেয়ারদরের উত্থানে হিরো গংয়ের কারসাজির সুস্পষ্ট প্রমাণ পায় স্টক এক্সচেঞ্জ। ডিএসইর কারসাজির নমুনা দিতে ডিএসই তার প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট গ্রাফ করেও দেখিয়েছে, কীভাবে হিরো সিন্ডিকেট শেয়ারটির দর বাড়ায়।

যেমন- গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টা ৩৫ মিনিট ৪৯ সেকেন্ড থেকে ১১টা ৪০ মিনিট ২৯ সেকেন্ডের মধ্যে হিরো এবং তাঁর সিন্ডিকেট মোট ২৩টি বিও অ্যাকাউন্ট থেকে নিজেরা শেয়ার কেনাবেচা করে পাঁচ মিনিটেরও কম সময়ে ডেল্টা লাইফের শেয়ারদর ১৫৯ টাকা থেকে ১৭৪ টাকায় তোলেন। একই বছরের ৩ অক্টোবরও একইভাবে সিরিয়াল ট্রেড করেন।

ওই দেড় মাসে পাবলিক ও ব্লক মিলে ডেল্টা লাইফের ১০ কোটি ৭১ লাখ ৩২ হাজার ৫৪৭টি শেয়ার কেনাবেচা হয়। এ কেনাবেচায় হিরো সিন্ডিকেট কেনা ও বেচা উভয় দিক মিলে ৪৯ শতাংশ লেনদেন করে। শুধু হিরো তাঁর নিজের, বাবা আবুল কালাম মাতবর, বোন কনিকা আফরোজ এবং নিজের নামসর্বস্ব সমবায় সমিতি ডিআইটি কো-অপারেটিভের নামে ৪ কোটি ১৫ লাখ ২০ হাজার শেয়ার কেনাবেচা করেন। এর মধ্যে ২ কোটি ১৩ লাখ ৪৯ হাজার ৫২৭টি শেয়ার কিনে বিক্রি করেন ২ কোটি ১ লাখ ৭০ হাজার ৫০৩টি শেয়ার।

ডিএসই এ ঘটনায় মাত্র দেড় মাসের কারসাজি নিয়ে তদন্ত করলেও সমকাল আরও বিশদ অনুসন্ধান করেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল ৬৫ টাকা দরে কেনাবেচা হয়। এর ছয় মাস পর ২৬ অক্টোবর শেয়ারটির দর ২৩৯ টাকায় ওঠে। হিরো তাঁর স্ত্রীর নামে এ কোম্পানির শেয়ার প্রথম কিনেছিলেন ২০২১ সালের ৩০ মে ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজ থেকে (বিও নং ১২০৫৫৯০০৬৮২৮৪৯৭৩)। ওই দিন শেয়ারটির দর ছিল ১০০ টাকা। ওই দিন তাঁর স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে মাত্র ২৮ হাজার শেয়ার এবং ১ জুন আরও এক লাখ শেয়ার কিনেছিলেন।

ডেল্টা লাইফের শেয়ার নিয়ে হিরোর কারসাজি শুরু মূলত গত বছরের ২৮ জুন থেকে। ওইদিন লেনদেনের প্রথম মিনিটেই ১ কোটি ৫ লাখ শেয়ার কেনাবেচা হয়। সমঝোতার মাধ্যমে পাবলিক মার্কেটেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবি তার এক কোটি ৫ লাখ শেয়ার ওই দিনের সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ দর ১২৯ টাকা ১০ পয়সায় বিক্রি করে। এর প্রায় পুরোটাই বিভিন্ন নামে কিনে নেয় হিরো চক্র।

এর মধ্যে হিরোর স্ত্রী সাদিয়া হাসানের ইউসিবির ব্রোকারেজ হাউসের হিসাব থেকে ২৪ লাখ এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ক্যাপিটাল থেকে দুই লাখ এবং ইবিএল সিকিউরিটিজ থেকে ডিআইটি কো-অপারেটিভের নামে (বিও নং ১২০৫৫৯০০৬৫৭৫৭৮১১) পাঁচ লাখসহ মোট ৩১ লাখ শেয়ার ৪০ কোটি টাকায় কেনা হয়। ওইদিন সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেসও ওই একই দরে ৪ লাখ ২৬ হাজার শেয়ার সাড়ে ৫ কোটি টাকায় কিনেছিল।

ওই দিন সকালে ডেল্টা লাইফের অস্বাভাবিক লেনদেন দেখে নানা সূত্রে খবর নিয়ে অনলাইনে একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়। ওই রিপোর্টে আবুল খায়ের হিরো বলেছিলেন, ‘আমি না, আমার এক ক্লায়েন্ট কেনার আদেশ দিয়েছিল। আমি (২৭ জুন ২০২১) কিনেছিলাম। ২৫-৩০ লাখ শেয়ার পাইছি।’

জানা গেছে, হিরো তাঁর যে ক্লায়েন্টের নামে শেয়ার কেনা কথা বলেছিলেন, তিনি একজন ক্রিকেটার।

অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, গত বছরের ২৯ জুলাই ইউসিবি ব্রোকারেজ হাউস থেকে হিরো তাঁর নিজ নামের অ্যাকাউন্ট থেকে ৫০ হাজার এবং তাঁর বাবা আবুল কালাম মাতবরের নামে খোলা অ্যাকাউন্ট থেকে আরও ৫০ হাজার শেয়ার কিনেছিলেন। তাঁর আগ্রাসী শেয়ার ক্রয়ে মাত্র চার দিনে ডেল্টার শেয়ার ১১৭ টাকা থেকে ১৬৪ টাকা ছাড়ায়।

এভাবে হিরো প্রথম দফায় ১২ আগস্ট পর্যন্ত শেয়ার কিনেছেন। ১৭ আগস্ট থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় টানা বিক্রি করেছেন। আবার দ্বিতীয় দফায় ২২ সেপ্টেম্বর থেকে কেনা শুরু করে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত কিনে ৬ জানুয়ারির পর এপ্রিল পর্যন্ত বিক্রি করে মুনাফা তুলেছেন।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, হিরো তার বাবার অ্যাকাউন্টে ২০২১ সালের ২৯ জুন থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেল্টা লাইফের ৭৬ লাখ ১৬ হাজার ৬৬৮টি শেয়ার কেনেন। এ পুরো শেয়ারই ওই একই বছরের ১২ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৯ জুলাইয়ের মধ্যে বিক্রি করেন।

এ ছাড়া ইউসিবি ব্রোকারেজ থেকে হিরো ও তাঁর স্ত্রীর যৌথ অ্যাকাউন্ট (১২০৫৫৯০০৭১০৯১১১৬) থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৭৫টি শেয়ার কিনে পুরোটা বিক্রি করেন। ডিআইটি কো-অপারেটিভের নামে ইবিএল, ইউসিবি এবং এসবিএল ক্যাপিটাল থেকে তিন অ্যাকাউন্টে ৭০ লাখ ১৭ হাজার শেয়ার কিনে ৪২ লাখ শেয়ার বিক্রি করেন। স্ত্রী সাদিয়ার ইউসিবি ও এসবিএল ক্যাপিটালের অ্যাকাউন্ট থেকে ৯৩ লাখ ৯৭ হাজার শেয়ার কিনে পুরোটাই বিক্রি করেন।

বোন কনিকা আফরোজের নামে ইউসিবি (বিও নং- ১২০৫৫৯০০৭২৫৫৩২৯০) ও এসবিএল ক্যাপিটালের অ্যাকাউন্ট (বিও নং-১৬০৪৫৩০০৭২৫৫৩২৯০) থেকে ৭৫ লাখ ৪১ হাজার শেয়ার কিনে ৪০ লাখ ১৪ হাজার শেয়ার বিক্রি হয়। হিরো তাঁর নিজের নামের ইবিএল ও ইউসিবির অ্যাকাউন্ট থেকে ১৪ লাখ ১১ হাজার শেয়ার কিনে গত ২৯ মার্চ পর্যন্ত ১৩ লাখ ২৩ হাজার শেয়ার বিক্রি করেন।

সার্বিক হিসাবে হিরো তাঁর নিজের পরিবারের সদস্য এবং স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ২০২১ সালের ৩০ মে থেকে চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত ৩ কোটি ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ১০০টি শেয়ার কেনেন। বিপরীতে ২০২১ সালের ২৯ জুন থেকে চলতি বছরের ১০ মে পর্যন্ত ২ কোটি ৬৮ লাখ শেয়ার বিক্রি করেন। গত ১০ মে পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হিরো তাঁর নিজের ও স্ত্রীর অ্যাকাউন্ট থেকে সব শেয়ার বিক্রি করেন। তবে এখনও বাবার অ্যাকাউন্টে ২৫ লাখ এবং বোনের অ্যাকাউন্টে ২৫ লাখ শেয়ার রয়েছে।

এ ছাড়া ডিআইটি কো-অপারেটিভের নামে রয়েছে আরও ২ লাখ শেয়ার। প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের পর তিনি একে একে বীমা খাতের এশিয়া, এশিয়া প্যাসিফিক, ডেল্টা লাইফ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল, রূপালী, ইস্টার্ন, প্রভাতী, নর্দার্ন, ঢাকা, নিটল প্রভৃতি ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর বাড়াতে কারসাজি করেন। এর বাইরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিডিকম, জেনেক্স ইনফোসিস এবং এডিএন টেলিকমের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করেন। এর বাইরে সোনালি পেপার, আইপিডিসি, ন্যাশনাল হাউজিং, এনআরবিসি, ওয়ান ও ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক, ফরচুন শুজ, সাফকো স্পিনিং, কুইনসাউথ টেক্সটাইল, মালেক স্পিনিং, হামিদ ফেব্রিক্স ইত্যাদি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে হিরোর কারসাজির প্রমাণ মিলেছে।

ডিএসইর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এভাবে সংঘবদ্ধভাবে নিজেরা শেয়ার কেনাবেচা করা এসইসি অধ্যাদেশ ১৯৬৯ এর ১৭(ই)(৫) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। গত জুনে এশিয়া, ঢাকা ও গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির ঘটনায় বিএসইসি হিরোকে বাদ দিয়ে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, তার আদেশে আইন লঙ্ঘনের এ বিষয়টি বিএসইসিও অনুমোদন করেছে।

তথ্য সূত্র : সমকাল

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাত দিনের সর্বাধিক পঠিত