সিনিয়র রিপোর্টার: পুঁজিবাজারে ইসলামিক গ্রিন সুকুক বন্ডের চালুর আগে এটি নিয়ে যে প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছিল, তার প্রমাণ মেলেনি লেনদেনে।
তিন হাজার কোটি টাকার বন্ডে অর্ধবার্ষিক বা ছয় মাসে ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ বা প্রতি ১০০ টাকার বন্ডে ৫ টাকা ৮০ পয়সা নগদ লভ্যাংশও এসেছে। এই হারে লভ্যাংশ যেকোনো সঞ্চয়ী হিসাবের চেয়ে বেশি লাভ, তার পরও বিনিয়োগকারীদের বন্ডের লেনদেনে খুব একটা আগ্রহী দেখা যাচ্ছে না।
সুকুকের লেনদেন শুরু হয় গত ১৩ জানুয়ারি। প্রথম দিন হাতবদল হয় ৩২ লাখ ৩২ হাজার ৭৭২টি ইউনিট লেনদেন হলেও এরপর আর তেমন লেনদেন হয়নি। দ্বিতীয় দিনই লেনদেন নেমে আসে ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৮০৪টিতে। পরের দিন হাতবদল হয় ৬ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৯টিতে। তৃতীয় দিনের চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে কেবল একদিন।
গত ২৮ জুন হাতবদল হয় ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৫৯৪টি ইউনিট। বাকি দিনগুলোর মধ্যে এক লাখ ছাড়ানো লেনদেন হয়েছে কেবল ১১ কর্মদিবসে। এর মধ্যে ৫ লাখের বেশি হাতবদল হয়েছে কেবল দুই দিন। অথচ তিন হাজার কোটি টাকার বন্ডে ইউনিট সংখ্যা ৩০ কোটি। এই পরিমাণ শেয়ার আছে যেসব কোম্পানির, সেগুলোর লাখ লাখ ইউনিট হাতবদল হয় নিয়মিত।
ইউনিট হাতবদল কম হওয়ার কারণ খুঁজতে শেয়ার লেনদেনে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, হাওলার চার্জ বা মাশুল সমস্যায় বিনিয়োগকারীরা চিন্তিত।
পুঁজিবাজারে সিকিউরিটিজের প্রতিটি ক্রয় বা বিক্রয় আদেশকে বলা হয় হাওলা। বন্ডের লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতি হাওলায় ফি ঠিক করা হয়েছে ৫০ টাকা। কেউ বন্ড কিনতে চাইলে এক হাওলায় কতগুলো পাওয়া যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু তার কাছ থেকে নেয়া হবে ৫০ টাকা। এটিই সুকুক বন্ডের লেনদেনে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কেউ এক হাজার বন্ড কিনতে চাইলেন। তিনি এক হাওলায় ১০০টি পেলে তার জন্য দিতে হবে ৫০ টাকা। অর্থাৎ বন্ডপ্রতি ৫০ পয়সা। কিন্তু যদি এক হাওলায় তিনি পান ১০টি বন্ড, তাহলে বন্ডপ্রতি মাশুল দাঁড়ায় ৫ টাকা। আর যদি তিনি একবারে ৫টি পান, তাহলে মাশুল দাঁড়ায় ১০ টাকা।
যদি বিক্রেতার সংখ্যা ২০ জন হয়, তাহলে হাওলা মাশুলের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার টাকা। এভাবে কাঙ্ক্ষিত বাই অর্ডারে যত বেশি হাওলার সংখ্যা বাড়বে তত বেশি বিনিয়োগ ব্যয় বাড়বে। একই কথা যারা বিক্রি করবেন, তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরের আগে শেয়ার বিক্রি হতো লট হিসেবে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সংখ্যক বা এক গুচ্ছ শেয়ারকে বলা হতো লট। এক লট শেয়ার লেনদেনের জন্য তখন ব্রোকারেজ হাউস থেকে হাওলা বাবদ চার টাকা অর্থাৎ ক্রয় বাবদ দুই টাকা ও বিক্রয় বাবদ দুই টাকা মাশুল নিত স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি ক্রয় বা বিক্রয় আদেশকে একটি হাওলা হিসেবে বিবেচনায় ধরে এ মাশুল আদায় করা হতো।
তবে ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে নতুন লেনদেন যন্ত্র চালুর পর শেয়ারের গুচ্ছ প্রথা তুলে নেয় এক্সচেঞ্জগুলো। এরপর থেকে একটি করে শেয়ার বা মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিটও লেনদেন করা যায়। আর এই পরিবর্তনের পর হাওলার মাশুল পরিবর্তন করে শেয়ারদরের শতকরা হিসেবে মাশুল নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বন্ডের ক্ষেত্রে আগের পদ্ধতিতেই মাশুল আদায় করা হচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের বন্ড মার্কেট খুবই ছোট। এর পরিধি বাড়াতে হলে বন্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ তৈরি করতে হবে। বন্ডের হাওলা মাশুলকে পরিবর্তন করে শেয়ার লেনদেনের মতো মাশুল নির্ধারণ করা যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে বন্ড মার্কেট নেই বললেই চলে। হাওলা মাশুল ক্ষুদ্র বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা।
একজন বিনিয়োগকারী যে পরিমাণ বন্ড কিনতে আগ্রহী তা একবারেই তার অ্যাকাউন্টে জমা হবে না। দেখা যাবে, চাহিদার বিপরীতে সেল অর্ডার কম। তখন ওই বিনিয়োগকারী কয়েকবারে ভেঙে ভেঙে ওই পরিমাণ ইউনিট পাবেন। এতে হাওলার সংখ্যা বেড়ে যাবে। খরচও বেড়ে যাবে। খরচ বেড়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই কিছুটা উৎসাহী হলেও কিনতে সাহস করবে না।
অভিন্ন মত দিয়েছেন পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, সুকুক বন্ডের হাওলা ফি ট্রেডের ক্ষেত্রে আসলেই একটা বাধা। যে পরিমাণ ইউনিট বাই অর্ডার দেয়া হবে সেটা একবারেই পাওয়া যাবে এমন না। বারে বারে পেলে হাওলার সংখ্যা বাড়বে, এতে করে যিনি শেয়ারটা কিনলেন তার কিন্তু কস্টিং বেড়ে যায়।
ব্যয় কমানোর জন্য একবারে চার্জ কেটে নেয়ার দাবি জানান বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের এই নেতা। তিনি বলেন, যদি কেউ সুকুক বন্ডের ৫০০ ইউনিট কেনেন, সেটা যতবারেই হোক ওই ইউনিটের ওপর একবারই ফি কেটে নেয়া হোক।’
ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, আমরা চাই যে, বাজার বড় হোক, বন্ডের বাজার সম্প্রসারিত হোক। বন্ডের যে হাওলা চার্জ তা অনেক বেশি।
বিনিয়োগ বাড়াতে হলে এই ফি কমানো প্রয়োজন। মানুষকে কোনো জিনিসে অভ্যস্ত করতে হলে আগে ফ্রি করে দিতে হবে। উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ, প্রথমে ফ্রি করে দেয়, এরপর মানুষ যখন সেটা ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন এর সঙ্গে চার্জ জুড়ে দেয়া হয়। সেভাবে বন্ড মার্কেট জনপ্রিয় করতে হলে এর শর্তগুলো শিথিল করতে হবে। স্টক মার্কেট খারাপ হলে টাকা বন্ড মার্কেটে যাবে, বন্ড মার্কেট খারাপ হলে স্টক মার্কেটে যাবে। এটাই টাকার ধর্ম।
তবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসই কর্তৃপক্ষের দাবি, যে পদ্ধতিতে সুকুক বন্ডের হাওলা মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে তা বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভজনক।
ডিএসইর চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, ট্রানজেকশন ফি কম রাখার জন্যই এটা করা হয়েছে। যখন কেউ বেশি পরিমাণে কিনবেন তখন খরচ অনেক কম পড়বে।
তিনি আরও বলেন, কেউ এক-দুই ইউনিট বন্ড কিনবে সেটা অ্যাকসেপ্টেড না বা সেভাবে ডিজাইন করা হয়নি। বেশি যখন কিনবে তখন কম হয়ে রেট হবে। যদি কেউ একবারে ২৫ হাজার কিনতে পারে তখন সেটার চার্জ ০.২ পড়ে। তাহলে দেখা যাবে যে, ইক্যুয়িটির যে রেট সেই রেটই পড়বে। যদি আরও বেশি কেনে কেউ, তাহলে আরও কম পড়বে।
তিনি বলেন, বন্ড মার্কেট ডিজাইন করা আছে যেন কেউ একটা রিজনেবল কোয়ান্টিটি কেনে। তাহলে ব্লক মার্কেটে কিনতে পারে, সেখানে কিনলে একবারে ৫ লাখ টাকার একবারে কিনতে পারবে। বন্ড মার্কেটে ফি কম রাখার জন্যই এটা করা হয়েছে।
কত হাওলাতে কাঙ্ক্ষিত ইউনিট পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা নেই, সেক্ষেত্রে খরচ তো বেশি হয়ে যাবে না?- এমন প্রশ্নে সাইফুর মজুমদার বলেন, সুকুক আসার পরে খুচরা লেনদেনে কিছু সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। বন্ড মার্কেট পার্সিয়ালি চালু হয়েছে, গর্ভমেন্ট সিকিউরিটিজ আসলে তখন এগুলো রিভাইজ হবে, তখন দেখা হবে।
এখন পর্যন্ত যেভাবে আছে, সেটা রাখা হয়েছে যাতে করে যারা কিনবেন তারা যেন একটা বাল্ক পরিমাণ কেনেন। এটা রাখা হয়েছে বন্ডে ফি কম থাকুক। বেশি বন্ড কিনলে তার ফি হবে নেগলিজেবল।