সিনিয়র রিপোর্টার: অলটেক্স ফেব্রিক্স নামে আসলে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানকে কিনে নিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি একটি কোম্পানি নতুন শেয়ার ইস্যু করতে চেয়েছিল।
তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্দেশে ডিএসইর তদন্তে ধরা পড়েছে সেই কারসাজির চেষ্টা। তাই তারা এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে।
বস্ত্র খাতের কোম্পানি অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ বছর কয়েক আগে ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জকে জানায়, তারা সহযোগী কোম্পানি অলটেক্স ফেব্রিক্স লিমিটেডকে কিনে নেবে। এ জন্য অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের নতুন শেয়ার ইস্যুর আবেদন করে। তবে বিএসইসি সেই আবেদনে সাড়া না দিয়ে উল্টো কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজকে।
বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের আরও তথ্য দরকার। সেই তথ্যগুলো পেলে আমরা পুরো সিদ্ধান্তটা নিতে পারব। আমরা সেই তথ্যগুলো চেয়ে পাঠিয়েছি।
এ বিষয়ে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের কোম্পানি সচিব জিয়াউল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে এই বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।’
বিএসইসি থেকে জানানো হয়, অলটেক্সের আবেদন পেয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এর একটি দলকে তদন্তে পাঠায় বিএসইসি। তবে সশরীরে যাচাইবাছাই করতে কারখানায় যাওয়ার পর তাদেরকে সহযোগিতা করা হয়নি। এমনকি কক্ষ তালাবদ্ধ করে বাধাও দেয়া হয়েছে।
বিএসইসি থেকে পাঠানো একটি চিঠিতে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে তদন্তে বাধা দেয়ার কারণও জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যেসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি, সেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, ডিএসইর তদন্ত দলকে সহযোগিতা করা হয়নি। কারখানায় তদন্তে গিয়ে প্রথমে তালাবদ্ধ দেখতে পায় তদন্ত দল। অনুরোধ করা হলেও তালা খুলে দেয়া হয়নি।
তদন্ত দলের প্রতিবেদনে যা আছে
ডিএসইর তদন্ত দলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, অলটেক্স ফেব্রিক্স লিমিটেড এবং অলটেক্স ডাইং, ফিনিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং মিলস লিমিটেড একই জায়গায় অবস্থিত বলে কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। কিন্তু কারখানার কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এর কোনো সত্যতা মেলেনি।
প্রধান কার্যালয়ের কর্মচারী এবং কারখানার কর্মচারীদের বক্তব্যের মধ্যে অমিলও পেয়েছে তদন্ত দল। অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড তাদের কারখানা হুয়াক্সিন টেক্সটাইল লিমিটেডের কাছে ভাড়া দিয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য দেয়নি। এছাড়া অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড হিসাব রাখার ক্ষেত্রে অনেক নয়-ছয় করেছে। যার ফলে তদন্ত দলের মতে কোম্পানির ইপিএস কৃত্রিমভাবে বেশি দেখাচ্ছে।
তদন্ত দল সরজমিনে গিয়ে দেখতে পেয়েছে কোম্পানির ভবন এবং যন্ত্রের অবস্থা ভালো না। এ ছাড়া তদন্ত দল অলটেক্স ফেব্রিক্সের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি।
লোকসানি কোম্পানির হঠাৎ ভেলকি
১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ একটি দুর্বল কোম্পানি হিসেবে পরিচিত। ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার পর প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ লোকসানের কারণে বিনিয়োগকারীরা কোনো লভ্যাংশ পায়নি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে থাকা তথ্য বলছে ২০১৭ সালে শেয়ার প্রতি ২ টাকা ১৩ পয়সা, পরের বছর শেয়ার প্রতি ৭ টাকা ৯৭ পয়সা, ২০১৯ সালে ৬ টাকা ৯ পয়সা, পরের বছর ৫ টাকা ৪৭ পয়সা এবং ২০২১ সালে শেয়ার প্রতি লোকসান দিয়েছে ৫ টাকা ৮ পয়সা।
তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে হঠাৎ যেন ভেলকি লেগেছে কোম্পানির আয়ে। এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি ১ টাকা ২৪ পয়সা লোকসান দেয়ার পর দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১ টাকা ৩৬ পয়সা মুনাফা দেখায় তারা। তৃতীয় প্রান্তিকে মুনাফা হয় শেয়ার প্রতি আরও ৩ পয়সা। সব মিলিয়ে তিন প্রান্তিক শেষে ১৫ পয়সা মুনাফা দেখিয়েছে কোম্পানিটি।
এর মধ্যে দ্বিতীয় প্রান্তিকের আর্থিক হিসাব প্রকাশের দিন চমক হিসেবে এক শতাংশ অর্থাৎ শেয়ার প্রতি ১০ পয়সা অন্তর্বর্তী লভ্যাংশ ঘোষণা করে কোম্পানিটি।
এই ঘোষণার পর শেয়ারদরে যেন আগুন লাগে। অন্তর্বর্তী লভ্যাংশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গত ৩১ জানুয়ারি, যা পরের দিন ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জকে জানানো হয় আনুষ্ঠানিকভাবে।
সেদিন শেয়ার দর ছিল ১৭ টাকা ১০ পয়সা। ১০ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণার প্রভাবে এখান থেকে কয়েক দিনে লাফ দিয়ে শেয়ারদর উঠে যায় ২৯ টাকা ৭০ পয়সায়।
এরপর সেখান থেকে কিছুটা কমলেও শেয়ারদর এখন ২৪ টাকা ৬০ পয়সা। এই অন্তর্বর্তী লভ্যাংশের কারণে টানা ছয় বছর ‘জেড’ক্যাটাগরিতে থাকা এ কোম্পানির শেয়ার বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে।
অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিশোধিত মূলধন ৫৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ এর শেয়ার সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮ হাজারটি। এর মধ্যে ৪০ দশমিক ৭৪ শতাংশ আছে পরিচালকদের হাতে।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ শেয়ার এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৪৮ দশমিক ৪০ শতাংশ।
টানা লোকসানের কারণে এর রিজার্ভ শূন্য হয়ে আরও ২৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা দায় তৈরি হয়েছে।
তারপরও প্রায় প্রতি বছরই নানা সময় কোম্পানিটির শেয়ারদর অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য ছিল ১২ টাকা ৯০ পয়সা আর দুই বছরে সর্বনিম্ন মূল্য ৭ টাকা ৪০ পয়সা।
এই শেয়ারদর নানা সময় বাড়ে নানা খবরে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে যখন অলটেক্স ফেব্রিক্স অধিগ্রহণের কথা জানানো হয়, তখন এক দফা লাফ দিয়ে পরে আবার কমে। এরপর আবার মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে আসে চামড়া খাতে বিনিয়োগের কথা। তবে তার অগ্রগতি কী, সে বিষয়ে আর কোনো তথ্য আসেনি।
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আফসার উদ্দিন আহমেদ এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। এর পরিচালনা পর্ষদে আছেন তার স্ত্রী এবং সন্তানরাও।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।