সিনিয়র রিপোর্টার: পুঁজিবাজারে ২০০১ সালে তালিকাভুক্ত হয়েছে কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড। দীর্ঘ ২০ বছরে বিনিয়োগকারীদের বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে কোম্পানির মুলধন বৃদ্ধি করে। তবে চলতি বছরে মাত্র ১ শতাংশ নগদ বা প্রতি শেয়ারে ১০ পয়সা লভ্যাংশ দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় থাকা কোম্পানি বিক্রির আভাসও মিলেছে। যদিও কর্তৃপক্ষ এখনো বিক্রির বিষয়ে মুখ খোলেনি। কারণ কোম্পানির নামে স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদে ১৮৭২ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। যা মূলধনের চেয়ে ঋণ প্রায় দ্বিগুণ।
তালিকাভুক্তির পর থেকে ২০টি অর্থবছর পার করলেও ১০ বছর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়নি। তবে ৯ বার বোনাস শেয়ার দিয়ে কোম্পানির মূলধন বৃদ্ধি করে। শুধুমাত্র ২০২২ সালে মাত্র ১ শতাংশ নগদ বা প্রতি শেয়ারে ১০ পয়সা লভ্যাংশ দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে।
যাকে ভিন্নভাবে দেখছেন সাধারণ বিনিয়াগকারীরা।
সম্প্রতি কেয়া কসমেটিকসের বিরুদ্ধে হিসাবে গরমিল, মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করাসহ একাধিক কারসাজির অভিযোগে গত ১০ অক্টোবর তিন সদস্যে বিশেষ অডিট কমিটি গঠন করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
কমিটির সদস্যরা হলেন- বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মিরাজ উস-সুন্নাহ। উপপরিচালক এম এ মালেক এবং সহকারী পরিচালক অম্নয় কুমার ঘোষ। কোম্পানির সর্বশেষ ৫ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন অডিট করবে।


অডিট টিম ৫ বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের পাশাপাশি কেয়া কসমেটিকস লিমিটেডের সঙ্গে কেয়া স্পিনিং মিলস, কেয়া কটন এবং কেয়া নিট কম্পোজিট লিমিটেডের একীভূতকরণ স্কিম পরীক্ষা করবে। নিরীক্ষকরা কোম্পানিগুলোর সম্পদ, দায় এবং ইক্যুইটিগুলোতে কারসাজি হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখবে।
কোম্পানির তথ্য মতে, কেয়া কসমেটিকসকে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একিভূতকরণ প্রস্তাব ২০১৫ সালে অনুমোদন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অডিট কমিটি একিভূতকরণের আগের আর্থিক প্রতিবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখবে। পাশাপাশি অডিট কমিটি গত ১০ বছরের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বহির্ভূত লেনদেনগুলো বিশেষভাবে ক্ষতিয়ে দেখবে।
অন্যদিকে এই কমিটি কেয়া কসমেটিকস ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ ৫ বছরের সব মূল্যসংবেদনশীল তথ্যগুলো দেখবে। কোম্পানির সম্পদ, দায় এবং ইক্যুইটি যথাযথভাবে উপস্থিত ছিল কি না তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যালেন্স শিট এবং আর্থিক বিবৃতিগুলো পরীক্ষা করবে।
অডিট কমিটি প্রক্রিয়াগত মূলধনের কাজ, ইনভেন্টরি, প্রোপার্টি প্ল্যান্ট অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট (পিপিই), অস্পষ্ট, অগ্রিম আমানত এবং প্রিপেমেন্ট, টার্নওভার, বিক্রিত পণ্যের খরচ, বাণিজ্য প্রাপ্য, প্রশাসনিক খরচ এবং বর্তমান সম্পদ পর্যালোচনা করবে, যা কোম্পানির সর্বশেষ প্রতিবেদনে রয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, ২০০১ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ারের সর্বশেষ লেনদেন (১০ নভেম্বর) হয়েছে ৬ টাকা ৪০ পয়সা।
এদিকে বাজারে খবর চড়াও হয়েছে, কোম্পানিটির মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে। এ বিষয়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এ খবর সত্য নয়, সম্পূর্ণ গুজব বলে জানিয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কেয়া কসমেটিকসের কোম্পানি সচিব নূর হোসেন বলেন, অডিট কমিটির চিঠি এখনো হাতে পাইনি। পেলে বিএসইসির নির্দেশনা অনুসারে কাজ করবো।
বাজারে ছড়ানো বিভিন্ন গুজব নিয়ে তিনি বলেন, প্রায় দিনই কোনো না কোনো বিনিয়োগকারী ফোন দিয়ে জানতে চান কবে কার সঙ্গে মালিকানা পরিবর্তন হবে। এই কোম্পানি যদি আরেক কোম্পানির উদ্যোক্তারা কিনতে চায় তবে ফরমালি চিঠি দেবে। কিন্তু এ ধরনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এটা সত্য নয়, গুজব।
কোম্পানির অবস্থা
২০০১ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি জুলাই ২০১৯ থেকে জুন ২০২০ অর্থবছরে ১ শতাংশ (অর্থাৎ শেয়ার প্রতি ১০ পয়সা) লভ্যাংশ দিয়েছে। এরপর ২০২১ ও ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ফলে বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন অন্ধকারে। এই অবস্থায় কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমে ফেসভ্যালুর নিচে নেমেছে।
ডিএসইর তথ্য মতে, ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ছিল ৪ টাকা ৫০ পয়সা। সেখান থেকে হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী বাজারে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট ১০ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হয়। এরপর শেয়ারটির দাম কমতে শুরু করে, যা অব্যাহত রয়েছে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ে শেয়ারটির দাম কমতে কমতে ৬ টাকা ৪০ পয়সায় নামে। আর শেয়ারটি কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১১০ কোটি ২৩ লাখ ১৭ হাজার ৩২৫ শেয়ারধারী।
ঋণে জর্জরিত কেয়া কসমেটিকস
২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, কোম্পানিটির মূলধন হলো ১ হাজার ১০২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এই কোম্পানির বর্তমান ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৮৭২ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ মূলধনের চেয়ে ঋণ প্রায় দ্বিগুণ।
এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৭৪২ কোটি ৯১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ১ হাজার ১৩০ কোটি ৯১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ঋণের পাশাপাশি কোম্পানির রিজার্ভও ঋণাত্মক রয়েছে ৮৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
কেয়া কসমেটিকসের মালিকের নামে ৫ মামলা
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে কেয়া কসমেটিকস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক পাঠান, তার স্ত্রী ও তিন সন্তানের বিরুদ্ধে পৃথক মোট ৫টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের অভিযোগ, পরিবারের সদস্যরা মিলে প্রায় ১৮৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও ৯৬ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চেয়ারম্যান আবদুল খালেকের স্ত্রী ফিরোজা বেগম, ছেলে মাসুম পাঠান ও তার মেয়ে তানসীন কেয়া কসমেটিকসের পরিচালক। তার আরেক মেয়ে খালেদা পারভীন কেয়া কসমেটিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।
২০২১ সালের শেষ দিকে দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারাসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২০১২ এর ৪ (২) ধারায় কেয়া কসমেটিকসের পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শফি উল্লাহ।
সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগের পরামর্শ
দুই বছর ধরে হদিস না থাকা, ঋণ-মামলায় জর্জরিত এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমদ। তিনি বলেন, গুজব নির্ভর কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করাই উত্তম। শতভাগ লাভ হলেও সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে এসব কোম্পানিতে।
কেয়া গ্রুপ হলো বাংলাদেশের ঢাকা-কেন্দ্রিক একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। আব্দুল খালেক পাঠান ১৯৯৬ সালে কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা রয়েছে গাজীপুরে।