Homeবিশেষ সংবাদব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদত্যাগ

ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদত্যাগ

সিনিয়র রিপোর্টার: বেশিরভাগ ব্যাংকারের ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত লক্ষ্য ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়া। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে এ পদগুলো। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদত্যাগের ফলে বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হয়েছে।

একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকার হিসেবে পরিচিত মেহমুদ হোসেন। সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি এবং সিইও পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের হস্তক্ষেপে এক সপ্তাহ পর পুনরায় স্বপদে ফিরে যান এ কর্মকর্তা।

তবে সবাই মেহমুদ হোসেনের মতো ভাগ্যবান নয়, কারণ গত কয়েক বছরে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের এক ডজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন বা স্বেচ্ছায় চলে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্যাংক খাতে দক্ষ ও যোগ্য এমডি এবং সিইওদের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে উদ্বেগের বলে মন্তব্য করেছেন।

এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, মূলত সংকটাপূর্ণ ব্যাংকগুলোতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পদগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক এবং অন্য দুই-তিনটি বাদে প্রায় সব ব্যাংকই কর্পোরেট গভর্নেন্সের অভাবে ভুগছে, যা চলমান পরিস্থিতির মূল কারণ।

মেহমুদ হোসেনের পদত্যাগের আগে, ন্যাশনাল ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ সৈয়দ আবদুল বারী ২০২১ সালের নভেম্বরে পদত্যাগ করেন।

খন্দকার রাশেদ মাকসুদ এই জানুয়ারিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও হিসাবে তার তিন বছরের চুক্তি শেষ করার পর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড ছেড়েছেন।

গত কয়েক বছরে; ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিলো মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে, মোহাম্মদ নুরুল আমিনকে মেঘনা ব্যাংক থেকে, তরিকুল ইসলাম চৌধুরী এবং মোঃ গোলাম ফারুক তাদের মেয়াদ শেষ করার আগে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেন।

তাদের বেশিরভাগই পদত্যাগের কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত বা স্বাস্থ্যের অবনতির কথা উল্লেখ করেছেন।

কেউ কেউ ব্যাংকের এমডির পদ ছেড়ে পরে উদ্যোক্তা হয়েছেন। তাদের একজন আরফান আলী, যিনি গত বছরের আগস্টে চাকরি ছেড়ে দেন। ২০১৬ সাল থেকে তিনি ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

আরফান শুরু থেকেই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। এখন তিনি জায়টুন বিজনেস সলিউশনের চেয়ারম্যান।

তিনি তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রামে ডিজিটাল বুথ স্থাপন করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুর্গম জনগণকে প্রযুক্তি ভিত্তিক আর্থিক পরিষেবার আওতায় আনার পরিকল্পনা করছেন।

আলাপকালে সাবেক এ কর্মকর্তা বলেন; স্বাধীনভাবে কাজ করতে পছন্দ করার কারণে-ই ব্যাংকার থেকে উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছেন তিনি।

রাহেল আহমেদ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং এরপরই সিইও হিসেবে ডিজিটাল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার-নগদ-এ যোগদান করেন।

তিনি গত বছরের আগস্টে সেখান থেকেও পদত্যাগ করেন। বর্তমানে তিনি অগ্রিম নামে একটি স্টার্টআপ চালু করেছেন। যার লক্ষ্য একাধিক শিল্পের কর্মচারীদের জন্য অর্জিত বেতনের বিপরীতে তাৎক্ষণিক আর্থিক প্রয়োজন পূরণ।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) মো. মাহবুব উল আলম এবং আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি চেয়ারম্যান এবং অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

এরপর তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। যা বর্তমানে বহুল আলোচিত ইস্যু।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, যখন একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং চেয়ারম্যান অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে, তখন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না।

আজকাল, আমরা লক্ষ্য করছি বেসরকারি ব্যাংকের কিছু পর্ষদ সদস্য ব্যাংকিং কার্যক্রম, ক্রয় এবং নিয়োগের মতো ব্যবস্থাপনার কাজে জড়িত হচ্ছে। এ ধরনের পরিচালনা পর্ষদ ঋণ অনুমোদন এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনার উপর তাদের প্রভাব বিস্তার করছে। ফলস্বরূপ, স্থানীয় এবং বিদেশে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এমন সিনিয়র ব্যাংকাররা চাপের মধ্যে পড়ছেন এবং শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন।

ব্যাংকিং সেক্টরে কর্পোরেট গভর্নেন্স আনা অপরিহার্য উল্লেখ করে তিনি বলেন; একটি ব্যাংকের পর্ষদে স্বাধীন পরিচালকের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং সুশাসনের পক্ষে আওয়াজ তুলতে তাদের সক্ষম হতে হবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সম্প্রতি পদত্যাগ করা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীরা সকলেই সংকটাপূর্ণ ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। এমডি এবং সিইও’রা সেই ব্যাংকগুলিতেই নিরাপদ যেখানে কঠোরভাবে সুশাসন মেনে চলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রবণতার জন্য আংশিকভাবে দায়ী, কারণ নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল সেই ব্যাংকারদের রক্ষা করা। কিন্তু সেটি করা হয়নি।

এ বিষয়ে ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ মেজবাউল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালে এমডি এবং সিইওদের সুরক্ষার জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, যাতে বলা হয়; যদি কোনও এমডি মেয়াদের আগে পদত্যাগ করতে চান তবে তাদের এক মাস আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে কারণসহ একটি আবেদন জমা দিতে হবে।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন; বেশিরভাগ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ বিশেষ নিয়ম অনুসরণ করেনি এবং নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকও এ বিষয়ে কোনও অনুসন্ধান করেনি।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাত দিনের সর্বাধিক পঠিত