সকল মেনু

পুঁজিবাজারে বিএসইসির সিদ্ধান্তে ‘ব্লক বৈষম্য’

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: ‘ফ্লোর প্রাইসের’ চেয়ে ১০ শতাংশ কম দামে শেয়ার কেনার সুযোগ পাচ্ছেন তুলনামূলক বড় বিনিয়োগকারীরা। একে ‘এক বাজারে দুই নীতি’ হিসেবে দেখছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।

তালিকাভুক্তির তৃতীয় বছরে নিজেদের সর্বোচ্চ আয় করে শেয়ার প্রতি ৭০ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণার পরও বহুজাতিক মোবাইল ফোন অপারেটর রবির শেয়ারে আগ্রহ ফেরেনি পুঁজিবাজারে।

সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার ‘নো প্রাইস লিমিট’ বা মূল্যসীমা না থাকার দিন ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ারটি হাতবদল হয়েছে বেঁধে দেয়া সর্বনিম্ন দর বা ‘ফ্লোর প্রাইস’ ৩০ টাকায়। তবে আগের কয়েক মাসের ধারাবাহিকতায় এদিনও ক্রেতা ছিল না বললেই চলে।

সারা দিনে ৫ হাজার ২৩৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির মাত্র ৩১ হাজার ৯২২টি শেয়ার হাতবদল হয় ৬৭ বারে। লেনদেন হয় ৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।

তবে ‘ব্লক মার্কেটে’ তুলনামূলক আগ্রহ ছিল বেশি। সেখানে ৫টি ট্রেডে ৩৭ লাখ ৪২ হাজার টাকায় হাতবদল হয় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬০০টি শেয়ার। এই শেয়ার লেনদেন হয়েছে ‘ফ্লোর প্রাইসের’ চেয়ে ১০ শতাংশ ছাড়ে ২৭ টাকায়।

বাজারে ধস ঠেকাতে গত ৩১ জুলাই থেকে দ্বিতীয়বারের মতো ‘ফ্লোর প্রাইস’ দেওয়ার পর লেনদেন যখন তলানিতে নেমে যায়, সে সময় ‘ব্লক মার্কেটে’ এভাবে ১০ শতাংশ ছাড়ে শেয়ার বিক্রির সুযোগ দেওয়া হয় নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে।

১৫ নভেম্বর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি জানায়, তার পরের কর্মদিবস থেকে এই সুযোগ মিলবে। তবে ‘ব্লকে’ কম দামে লেনদেন হলেও ফ্লোর প্রাইস কমে যাবে না। আবার ‘ব্লকে’ যে দর হবে, সেটি ‘মূল বাজারের’ দর হবে না।

এই আদেশকে ‘এক বাজারে দুই নীতি’ হিসেবে দেখছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষায় এ নীতি ‘বৈষম্যমূলক’, কারণ, ‘ব্লকে’ যে ছাড়ে কেনার সুযোগ আছে, সেটি সবার জন্য নয়। সেখানে একবারে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকার শেয়ার কিনতে হয়। ফলে যাদের বিনিয়োগ কম, তারা সেই সুবিধাটা পাচ্ছেন না, যাদের বিনিয়োগ বেশি, তারাই নিতে পারছেন।

এ কারণে ‘ব্লকে’ কম দামে কিনে মূল বাজারে বিক্রি করতে পারলেই ৫ লাখ টাকায় ৫০ হাজার টাকা মুনাফা করতে পারছেন এই ‘তুলনামূলক বড় বিনিয়োগধারীরা।’

‘ব্লকের’ প্রতি আগ্রহ বাড়ার পর এমনও দেখা গেছে, ‘মূল বাজারের’ চেয়ে সেখানে বেশি দরে লেনদেন হয়েছে, পরিমাণেও বেশি।

সোমবার ‘ব্লক মার্কেটে’ মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ৬ লাখ ৬০ হাজার ৪০৯টি শেয়ার হাতবদল হয় ১৪ টাকা ৯০ পয়সায়। অথচ ‘মূল বাজারে’ শেয়ারের দর ১৩ টাকা ৬০ থেকে ৭০ পয়সা। অর্থাৎ ‘ব্লকে’ সাড়ে ছয় লাখের বেশি শেয়ার কিনতে গিয়ে ক্রেতা বেশি খরচ করেছেন ৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা।

একই দিন প্রকৌশল খাতের আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের শেয়ার মূল বাজারে হাতবদল হয় ‘ফ্লোর প্রাইস’ ২১৩ টাকা ৩০ পয়সায়। ১০ বারে হাতবদল হয় কেবল ৫০৫টি শেয়ার।

অথচ সেদিন এ শেয়ার ১৯৬ থেকে ২৩১ টাকা ৯০ পয়সাতেও হাতবদল হয়েছে ‘ব্লক মার্কেটে’। তিন বারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৫৬টি শেয়ার লেনদেন হয় সেখানে। এই বিনিয়োগকারীরা মূল বাজার থেকে আরও সস্তায় একই কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারতেন।

কেবল রবির বা একদিনের চিত্র নয়

মূল বাজারের চেয়ে ব্লকে লেনদেন বেশি, এটি কেবল রবির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বা এক দিনের চিত্র নয়। গত কয়েক মাস ধরে নিয়মিতই এটা ঘটছে।

দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণ ফোনের শেয়ারেও রোববার এমন চিত্র দেখা গেছে। ‘মূল বাজারে’ ‘ফ্লোর প্রাইস’ ২৮৬ টাকা ৬০ পয়সায় ৩ হাজার ১৩৬ শেয়ারে হাতবদল হয় ৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

অথচ ‘ব্লক মার্কেটে’ ১৬ বারে হাতবদল হয় ৪২ হাজার ৫৩৭টি শেয়ার। লেনদেন ১ কোটি ১২ লাখ ২২ হাজার টাকা। সেখানে শেয়ার বিক্রি হয় ২৬১ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ২৬৬ টাকার মধ্যে।

পরদিন ‘ব্লকে’ গ্রামীণফোনের লেনদেন হয় ৪ কোটি ৩০ লাখ ৩৮ হাজার টাকায়, হাতবদল হয় ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৯২টি শেয়ার। লেনদেন হয় ২৬১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ২৬৮ টাকায়। অন্যদিকে মূল বাজারে বেঁধে দেয়া সর্বনিম্ন দরে ২৬ বারে ৪ হাজার ৩২৭টি শেয়ার হাতবদল হয় ১২ লাখ ৪০ হাজার ১১৮ টাকা।

রোববার মূল বাজারে বড় মূলধনি বেক্সিমকো লিমিটেডের ২০২টি শেয়ার ৮ বারে হাতবদল হয় ১১৫ টাকা ৬০ পয়সায়। মোট লেনদেন ২৩ হাজার ৩৫১ টাকা ২০ পয়সা।

অথচ ‘ব্লকে’ ৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় ৭ হাজার ৮৯টি শেয়ার লেনদেন হয় একবারে। দাম ছিল প্রায় ১০ শতাংশ কম, ১০৪ টাকা ১০ পয়সা।

পরদিন ‘ব্লকে’ ১০ শতাংশ ছাড়ে ৩৯ হাজার ৯৯৯টি শেয়ার লেনদেন হয় একবারে। ‘মূল বাজারে’ ৮ বারে ৫২২টি শেয়ার লেনদেন হয় ‘ফ্লোর প্রাইস’ ১১৫ টাকা ৬০ পয়সায়।

রোববার ‘মূল বাজারে’ স্কয়ার ফার্মার লেনদেন ছিল ৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা। ‘ফ্লোর প্রাইস’ ২০৯ টাকায় ৫৮ বারে লেনদেন হয় ২ হাজার ৯৮৯টি শেয়ার।

‘ব্লক মার্কেটে’ সর্বনিম্ন ১৯৮ টাকাতেও হাতবদল হয়েছে। ৪২ বারে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৬২৩টি শেয়ার লেনদেন হয় ৩ কোটি ৯৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকায়।

পরদিন ‘ব্লক মার্কেটে’ ১৭ বারে কোম্পানিটির ১ লাখ ২৪ হাজার ৭০০ টি শেয়ার লেনদেন হয় সর্বনিম্ন ১৯৮ টাকায়। কিন্তু ‘মূল বাজারে’ ‘ফ্লোর প্রাইসে’ ৫৩ বারে লেনদেন হয় ১৭ হাজার ২৫৬টি শেয়ার।

রোববার আর্থিক খাতের কোম্পানি আইপিডিসির ‘ফ্লোর প্রাইস’ ৫৭ টাকা ৬০ পয়সা করে ৬৪ হাজার টাকায় ১ হাজার ১১২টি শেয়ার হাতবদল হয় ‘মূল বাজারে’। ব্লকে সর্বনিম্ন ৫১ টাকা ৯০ পয়সাতেও হয়েছে লেনদেন। হাতবদল হয় ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০টি শেয়ার। টাকার অঙ্কে লেনদেন ২ কোটি ৭০ লাখ ৮ হাজার টাকা।

বেক্সিমকোর সুকুক বন্ডের ‘ফ্লোর প্রাইস’ ৮৫ টাকা। এই দরে রোববার একটিও হাতবদল হয়নি মূল বাজারে। কিন্তু ‘ব্লক মার্কেটে’ চার বারে ১ কোটি ২৮ লাখ ৪০ হাজার টাকায় হাতবদল হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৫৯ ইউনিট।

একই দিন আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার ‘মূল বাজারে’ তার ‘ফ্লোর প্রাইস’ ১১ টাকা ৫০ পয়সা দরে ১২ বারে লেনদেন হয় ৩০ হাজার ৬৮৮টি। টাকার অঙ্কে ৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।

অন্যদিকে ‘ব্লকে’ ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় হাতবদল হয় ৭ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার। দর ছিল ১০ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৫০ পয়সা।

এটা ‘বৈষম্য’

মূল মার্কেটে দাম কমতে পারবে না, অথচ ব্লকে ১০ শতাংশ কমে কেনা যাবে, বিএসইসির এমন সিদ্ধান্তকে ‘বৈষম্য’ হিসেবে দেখছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এর সিকিউরিটিজ কোম্পানিগুলোর সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর সভাপতি রিচার্ড ডি রেজারিও।

তিনি বলেন, ব্লক মার্কেটে ১০ শতাংশ কমে শেয়ার কেনার সুযোগ রয়েছে, আর মেইন মার্কেটে ফ্লোর প্রাইস রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে আর কী বলব?

“সবাইকে বাঁচাতে গেছে, কিন্তু একটা বাঁচানোর স্টাইল নয়, হতে পারে না। ব্লক মার্কেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি বা কেনার সুযোগ কম। কারণ, তাদের ৫ লাখ টাকার শেয়ারও নাই। থাকলেও সেটা বিভিন্ন কোম্পানির, একটি কোম্পানির নয়। এর ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কোনো লাভ নেই।”

তিনি বলেন, “এতে বাজারে ভিন্ন বার্তা যাচ্ছে। এটি কোনো বাজার ব্যবস্থা না-এখন তাই হয়ে উঠছে।”

রিচার্ডের এই বক্তব্যের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, সর্বোচ্চ সার্কিট ব্রেকার বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফলিও পরিবর্তন করার সুযোগ দিতে বাজার মধ্যস্থতাকারীদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ব্লক মার্কেটে ১০ শতাংশ কম দরে শেয়ার লেনদেনের সুযোগটি দেওয়া হয়েছিল। আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাজারের সামগ্রিক লেনদেন বৃদ্ধি পাওয়া। পাশাপাশি সেই মধ্যস্থতাকারীদের আয়ও একটু বৃদ্ধি পায়।

কিন্তু এই সিদ্ধান্তের কারণে মূল বাজারে যে লেনদেন কমে যাচ্ছে, সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “সাধারণত মোট লেনদেনের ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ব্লক মার্কেটে লেনদেন হয়। যা বাজারের মোট লেনদেনের তুলনায় খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ নয়।”

তবে এই ৫ থেকে ১০ শতাংশ লেনদেনের বিষয়টির প্রমাণ মিলছে না পরিসংখ্যানে।

রোববার ডিএসই ব্লক মার্কেটে লেনদেন ছিল ৪১ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা মূল বাজারে লেনদেনের ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এদিন ডিএসইতে মূল বাজারে লেনদেন হয় ২৮৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

পরের দিন মূল বাজারে লেনদেন ছিল ৩২৬ কোটি ৭২ লাখ ৬২ হাজার টাকা। সেদিন ‘ব্লকে’ হাতবদল হয় ৪৪ কোটি ৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। ‘মূল বাজারের’ তুলনায় ‘ব্লকে’র লেনদেন ছিল ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

বড় ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ভিন্ন নীতি আর কতদিন চলবে এমন প্রশ্নে বিএসইসির মুখমাত্র বলেন, কমিশন (বিএসইসি) প্রয়োজন সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করলে তা জানিয়ে দেওয়া হবে।

‘ব্লক মার্কেট’ কী

এটি এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে বেশি পরিমাণে শেয়ার কেনাবেচা হয় যার শেয়ারের দাম এবং সংখ্যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আগে থেকেই ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে ঠিক করা থাকে। ‘মূল বাজারের’ মত শেয়ারের দর হেঁকে সেখানে অচেনা কারও কাছ থেকে কেনার সুযোগ নেই।

ডিএসই এর যে ট্রেডিং প্লাটফর্ম বা সফটওয়্যার আছে তার মাধ্যমেই এই ‘ব্লক মার্কেটে’ লেনদেন হয়।

মহামারীর কারণে ২০২০ সালের ১৯ মার্চ ‘ফ্লোর প্রাইস’ নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিন্তু অধিকাংশ কোম্পানিতে ক্রেতা না থাকায় লেনদেন তলানিতে চলে যায়। সেই পরিস্থিতিতে ওই বছরের ১০ জুন ‘ব্লক মার্কেটে’ সেই ‘ফ্লোরের’ নিচে লেনদেন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

পরে অবশ্য শেয়ারের ক্রয় চাপ বাড়ে এবং ‘ফ্লোর’ ছাড়িয়ে যায় সিংহভাগ কোম্পানি। কোভিডের প্রকোপ কমার সঙ্গে সঙ্গে ধাপে ধাপে ‘ফ্লোর প্রাইস’ তুলে দেওয়া হয়। শুরুতে দেখা যায়, এতে শেয়ারগুলো দর হারাতে থাকলেও পরে ফ্লোরের দরকেও ছাড়িয়ে যায়। পরে ধাপে ধাপে ‘ফ্লোর প্রাইস’ তুলে নেওয়া হয়।

আর ‘ফ্লোর প্রাইস’ দেওয়া হবে না, এমন ঘোষণার পরও গত বছরের ২৮ জুলাই ডিএসইর প্রধান সূচক ৬ হাজার পয়েন্টের চেয়ে নিচে নেমে যাওয়ার পর অবস্থানে অটল থাকতে পারেনি বিএসইসি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top