সকল মেনু

ভিন্ন পথে হাঁটছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, লভ্যাংশ দিচ্ছে কম

সিনিয়র রিপোর্টার: ডেটল, মরটিন, হারপিক, ভ্যানিশ, লাইজল, ভিটসহ বেশ কয়েকটি প্রসাধন পণ্যের কল্যাণে বাংলাদেশে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে রেকিট বেনকিজার। ১৯৮৭ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতি বছর এই বহুজাতিক কোম্পানিটি যে মুনাফা করেছে তার প্রায় পুরোটা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছে।

নিয়মিত ভালো ব্যবসার সঙ্গে মোট লভ্যাংশ ঘোষণা করায় কোম্পানিটি খুব সহজেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করে নেয়। ফলে দামের দিকে থেকেও সবার ওপরে স্থান এই কোম্পানির। তবে শেয়ারবাজারে চলমান সংকটের মধ্যে এবার কিছুটা ভিন্ন পথে হেঁটেছে কোম্পানিটি।

একদিকে এই বহুজাতিক কোম্পানিটির মুনাফা কমেছে, অন্যদিকে কমেছে লভ্যাংশ ঘোষণার হার। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি যে মুনাফা করেছে তার ৭০ শতাংশ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতো কম হারে সাম্প্রতিক সময়ে আর লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি কোম্পানিটি। যেখানে গত কয়েক বছরে নিয়মিতই মুনাফার ৯০ শতাংশ বা তার বেশি লভ্যাংশ দিয়েছে।

রেকিট বেনকিজারের মতো নগদ লভ্যাংশে লাগাম টেনেছে আরেক বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার। ২০২২ সালের ব্যবসায় কোম্পানিটি যে মুনাফা করেছে, তার অর্ধেকও নগদ লভ্যাংশ হিসেবে দিচ্ছে না। অথচ এক বছর আগেই মুনাফার চেয়েও বেশি হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল কোম্পানিটি।

লভ্যাংশের হার কমিয়ে দেওয়ার এ তালিকায় রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোও। ডানহিল, লাকি স্ট্রাইক, কেন্ট, পলমল, কুল, বেনসন এবং রথম্যান্স তামাকজাত পণ্যের উৎপাদনকারী এ প্রতিষ্ঠানটি তামাকজাত পণ্য বিক্রির দিকে দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানটি এক বছর আগেও বিনিয়োগকারীদের মুনাফার প্রায় পুরোটা লভ্যাংশ হিসেবে দিয়ে দেয়। কিন্তু এবার মুনাফার ৬০ শতাংশ লভ্যাংশ হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এভাবে লভ্যাংশে হার কমিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে বহুজাতিক এসব কোম্পানির দায়িত্বশীলরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্বে এক ধরনের সংকট চলছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লভ্যাংশ কমিয়ে রিজার্ভ বাড়ানো হচ্ছে। এতে কোম্পানির আর্থিক ভিত আরও শক্তিশালী হবে।

অন্যদিকে নিয়মিত বড় লভ্যাংশ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করে নেওয়া এই কোম্পানিগুলোই এখন যেন বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। লভ্যাংশের হার কমার পাশাপাশি কিছু বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফাতেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে দিনের পর দিন ক্রেতা সংকটে ভুগছে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার।

অবশ্য এরমধ্যে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। তালিকাভুক্ত একাধিক বহুজাতিক কোম্পানি মুনাফার থেকে বেশি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মুনাফার থেকে বেশি লভ্যাংশ দেওয়ার কারণ হিসেবে এসব কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভালো রিজার্ভ এবং পর্যাপ্ত তারল্য থাকায় বেশি নগদ লভ্যাংশ দেওয়া হচ্ছে।

বরাবরের মতো সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশের ঘোষণা এসেছে রেকিট বেনকিজারের পক্ষ থেকে। কোম্পানিটি ৯৮০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শেয়ারপ্রতি ১৩৯ টাকা ৫০ পয়সা মুনাফা করে এ লভ্যাংশ দেওয়া হবে। এতে মুনাফার ৭০ শতাংশ লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করতে হবে।

২০২১ ও ২০২০ সালে মুনাফার থেকে বেশি লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের দিয়েছে ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার। অথচ এবার সেই কোম্পানিটি মুনাফার অর্ধেকও লভ্যাংশ হিসেবে দিচ্ছে না। ২০২২ সালের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি ৬০ টাকা ৬৪ পয়সা মুনাফা করা কোম্পানিটি ২৪০ শতাংশ নগদ ও ৬০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে শেয়ারপ্রতি নগদ লভ্যাংশ দেওয়া হবে ২৪ টাকা। অর্থাৎ মুনাফার মাত্র ৪০ শতাংশ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ হিসেবে দেওয়া হচ্ছে।

এক বছর আগে ২০২১ সালে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করে ৪৩ টাকা ৮০ পয়সা। এই মুনাফার বিপরীতে লভ্যাংশ দেওয়া হয় হয় ৪৪০ শতাংশ। তার আগের বছর ২০২০ সালেও ৪৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার। তখন শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৪৩ টাকা ৯৪ পয়সা। অর্থাৎ ২০২২ সালে মুনাফায় বড় উন্নতি হওয়ার পরও কোম্পানিটির নগদ লভ্যাংশের হার কমেছে।

একই পথে হেঁটেছে আরেক বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো। কোম্পানিটি ২০২২ সালের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি ৩৩ টাকা ১০ পয়সা মুনাফা করে ২০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিচ্ছে। অথচ এক বছর আগে ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি ২৭ টাকা ৭২ পয়সা মুনাফা করে ২৭৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি। তার আগে ২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ৬০ টাকা ৪৮ পয়সা মুনাফা করে ৬০০ শতাংশ নগদ ও ২০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দেওয়া হয়।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিনিয়োগকারীদের সব থেকে বেশি হতাশ করেছে সিঙ্গার বাংলাদেশ। লভ্যাংশে ধস নামার পাশাপাশি কোম্পানিটির মুনাফাতেও ধস নেমেছে। ২০২২ সালের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মাত্র ৭৩ পয়সা মুনাফা করেছে কোম্পানিটি। এরপরও ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।

অর্থাৎ মুনাফার থেকে বেশি কোম্পানিটি নগদ লভ্যাংশ দিচ্ছে। কিন্তু তা বিনিয়োগকারীদের খুশি করতে পারছে না। কারণ, এক বছর আগে শেয়ারপ্রতি ৫ টাকা ২০ পয়সা মুনাফা করে ৬০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। তার আগে ২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ৭ টাকা ৮৫ পয়সা মুনাফা করে ৩০ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ১০ টাকা ৩৫ পয়সা মুনাফা করে ৭৭ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় সিঙ্গার বাংলাদেশ।

মুনাফার থেকে বেশি নগদ লভ্যাংশের ঘোষণা এসেছে রবি এবং লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের কাছে থেকে। শেয়ারপ্রতি ৩৫ পয়সা মুনাফা করে ৭ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেবে রবি। অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি ৭০ পয়সা লভ্যাংশ দিতে হবে। এতে মুনাফার দ্বিগুণ অর্থ লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করতে হবে কোম্পানিটিকে। আগের বছর ২০২১ সালেও কোম্পানিটি মুনাফার অতিরিক্ত লভ্যাংশ দেয়। ওই বছর শেয়ারপ্রতি ৩৪ পয়সা মুনাফা করে কোম্পানিটি লভ্যাংশ দেয় ৫০ পয়সা (৫ শতাংশ নগদ)।

এবার লভ্যাংশের ক্ষেত্রে বড় চমক দেখিয়েছে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ। ২০২২ সালের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ৮৩ পয়সা মুনাফা করে কোম্পানিটি ৪৮ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিচ্ছে। অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ হিসেবে দেওয়া হচ্ছে ৪ টাকা ৮০ পয়সা। এর আগে কখনো কোম্পানিটি মুনাফার অতিরিক্ত অর্থ লভ্যাংশ হিসেবে দেয়নি। ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ৩৪ পয়সা মুনাফা করে ২৫ শতাংশ নগদ এবং ২০২০ সালে ২ টাকা ৩ পয়সা মুনাফা করে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি। ২০১৯ সালেও কোম্পানিটি ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। ওই বছরে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ১ টাকা ৫০ পয়সা।

এদিকে লভ্যাংশের সিদ্ধান্ত জানানো বাকি দুই বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে গ্রামীণফোন শেয়ারপ্রতি ২২ টাকা ২৯ পয়সা মুনাফা করে ২২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিচ্ছে। অর্থাৎ লভ্যাংশ হিসেবে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানিটি ২২ টাকা বিতরণ করছে। ২০২১ সালে ২৫ টাকা ২৮ পয়সা মুনাফা করে কোম্পানিটি ২৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০২০ সালে ২৭ টাকা ৫৪ পয়সা মুনাফা করে ২৭৫ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ২৫ টাকা ৫৬ পয়সা মুনাফা করে ১৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় গ্রামীণফোন।

অন্যদিকে আরএকে সিরামিকস শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৫৭ পয়সা মুনাফা করে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা দিতে হবে। আগের বছর ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ১২ পয়সা মুনাফা করে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি। তার আগে ২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ৭৩ পয়সা মুনাফা করে ১০ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ১ টাকা ৭৬ পয়সা মুনাফা করে ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় আরএকে সিরামিকস।

ভালো মুনাফা করার পরও নগদ লভ্যাংশ কম দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ারের চেয়ারম্যান মাসুদ খান বলেন, আমরা লভ্যাংশ কমিয়ে দিয়েছি, কারণ দেশের ভবিষ্যত কী হবে আমরা জানি না। অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এছাড়া ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও আমাদের করতে হচ্ছে। এ কারণে এবার লভ্যাংশ কমানো হয়েছে।

রেকিট বেনকিজারের কোম্পানি সচিব মো. নাজমুল আরেফিন বলেন, লভ্যাংশের বিষয়টি বোর্ডের সিদ্ধান্ত। আর সিনারিও তো সবসময় এক থাকে না। অনেক ব্যাংকে অনেক কিছু হচ্ছে, অনেক জায়গায় অনেক কিছু হচ্ছে।

বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কি আপনারা লভ্যাংশ কমিয়ে দেয়েছেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি আসলে সেরকম না। লভ্যাংশ কম বা বেশি দেওয়া অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে এখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ডিফারেন্ট। এলসি করতে সমস্যা হচ্ছে। আমাদের কোম্পানির কোনো সমস্যা নেই। সবকিছু ঠিক আছে।

ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর কোম্পানি সচিব মো. আজিজুর রহমান বলেন, লভ্যাংশের সিদ্ধান্ত বোর্ড থেকে এসেছে। বোর্ড যেভাবে চিন্তা করেছে, সেভাবেই দিয়েছেন।

লাফার্জহোলসিমের কোম্পানি সচিব কাজী মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যোগাযোগ বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এরপর তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ই-মেইলে লিখিতভাবে প্রশ্ন পাঠাতে বলেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে মুনাফার থেকে বেশি হারে লভ্যাংশ ঘোষণার কারণ কী, জানতে চেয়ে তাকে ই-মেইল করা হয়। ফিরতি মেইলে জানানো হয়, অ্যাকুমুলেটেড রিটেইন্ড আর্নিংস এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ নগদ প্রবাহ থাকায় এবার ইপিএসের চেয়ে লভ্যাংশ বেশি ঘোষণা করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top