স্টাফ রিপোর্টার: ব্যাংক খাতে ঋণের সুদ হার সর্ব্বোচ্চ ৯ শতাংশ প্রত্যাহারের বিরোধিতা করেছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, এমনকি ডলারের দাম বেড়ে যাবার কারণে দেশে ব্যবসা করা ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। এরপর যদি ঋণের সুদের সর্ব্বোচ্চ হার তুলে নেয়া হয় তবে দেশে ব্যবসা করা দূরূহ হয়ে পড়বে। তারা রফতানি খাতে উৎসে করে এক শতাংশ থেকে কমিয়ে আবার শূণ্য দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি করেছেন।
সোমবার বিকেলে অর্থমন্ত্রীর সাথে এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় তারা এসব কথা বলেন। আগামী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে এই বৈঠকটির আয়োজন করা হয়। বৈঠকে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যদি ঋণের সুদহার বাড়ানো হয় তবে ব্যবসায়িক ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ফলে ইতোমধ্যে ব্যবসায়িক ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এখন যদি সুদের বাড়ানো হয় তবে তাদের পক্ষে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি শঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, ডলারের স্বল্পতা ও বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার পাশাপাশি আগামী ক’মাসে রফতানি আয়ও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিস্থিতি মুদ্রার ভাসমান ব্যবস্থা চালু করার সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না।
আগামী অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হবে না, আশাবাদ ব্যক্ত করে এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, রাজস্ব বাড়ানোর জন্য পল্লী এলাকায়ও করজাল বিস্তৃতি করা জরুরি। কারণ এখন রাজস্ব আয়ের ৫০ ভাগই আসে বড় করদাতাদের কাছ থেকে।
এমসিসিআই সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সাড়ে ২৭ শতাংশ করারোপের যে শর্ত আরোপ করা হয়েছে আগামী বাজেটে তা প্রত্যাহার করা উচিত।
অর্থমন্ত্রীর ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, আগামী বাজেটে তাদের পরামর্শগুলো সর্বাত্মকভাবে সংযোজনের চেষ্টা করা হবে। অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সঞ্চালনে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতারা বক্তব্য রাখেন।
সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা, আর্থিক খাতের সংস্কার ও বৈষম্য কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ : এদিকে, সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত রোববার দেশের অর্থনীতিবিদদের সাথেও অর্থমন্ত্রীর এক প্রাক-বাজেট আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হলে কোভিডকালীন গৃহীত প্রণোদনা প্যাকেজ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আগামী বাজেটে নতুন উদ্যোগ নিতে হবে।
অন্যদিকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা রক্ষা জরুরি। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতায় ফাইন্যান্স কমিশন বা ব্যাংক কমিশন গঠন এবং বৈষম্য কমাতে সম্পদ কর চালু ও ধনীদের ওপর বাড়তি কর আরোপ করা প্রয়োজন। বৈঠকে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে আগামী বাজেটে কর কমিশন গঠন এবং খাদ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সব ভোগ্যপণ্যের জন্য প্রাইসিং পলিসি প্রণয়নেরও পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদরা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিডিপি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, দারিদ্র হ্রাস ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের সফলতা থাকলেও বৈষম্য বাড়ছে। সরকারের অনেক নীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৈষম্য বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। প্রত্যক্ষ করের বদলে পরোক্ষ কর আহরণে গুরুত্ব দেয়াও এমন একটি কারণ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে গণতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বৈষম্য অনেক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্ভ্রান্তরাই শুধু কোয়ালিটি শিক্ষা পাচ্ছে। একই অবস্থা স্বাস্থ্যখাতেও। তাই পাবলিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে বাজেটে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন ব্যয় বিশ্বে সর্বোচ্চ, এটি কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, এটা ম্যাক্রো-ইকোনমির ক্রেডিবিলিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইমেজ ও ইনভেস্টমেন্ট পলিসির সাথে সম্পৃক্ত। খেলাপি ঋণের সাথে বাজারের কিছু বড় প্লেয়ার সম্পৃক্ত। পুনঃতফসিল ও রাইট-অব সুবিধা দিয়ে রিসোর্সগুলোকে খেলাপিদের হাতে দেয়া হচ্ছে।
অথচ ব্যাংকের অর্থ আমানতকারীদের মধ্যে অনেকেই দরিদ্র। ঋণ খেলাপির সুবিধা দেয়াও সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। সব সরকারই বলে থাকে যে, ঋণ খেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু সব নির্বাচনের আগে ২%-৫% ডাউন পেমেন্টে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়ে তাদের নির্বাচনে প্রার্থী হতে সহায়তা করা হয়।
সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান বলেন, একটি সমস্যার সমাধান হলেই অর্থনীতির সব সমস্যা দূর হয়ে যায়, তা হলো- কর-জিডিপি বাড়ানো। তাই বাজেটে এদিকে মনোযোগ দিতে হবে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, বড় ঋণ খেলাপি কোম্পানিগুলোর খেলাপি ঋণকে আগামী অর্থবছর ইক্যুইটিতে রূপান্তর করে সরকার এগুলোর মালিকানা নিয়ে নিতে পারে। আর্থিক খাতের সমস্যা চিহ্নিত করতে ১৯৮১-৮২ সালে যেভাবে মানি অ্যান্ড ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হয়েছিল, এখনো তেমন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। এতে অন্তত সমস্যাগুলো চিহ্নিত হবে। পরে সরকার সমস্যা সমাধান করবে কি না, সেটি বিবেচনা করতে পারে।
ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে আগামী বাজেটে সীমিত পরিমাণে হলেও সম্পদ কর চালুর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অন্তত মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে এটি চালু করা যেতে পারে। গ্রামে মানবসম্পদ ও পুষ্টিসূচকের উন্নতি ঘটলেও নগরের দরিদ্র ২০% জনগোষ্ঠীর কোনো উন্নতি হচ্ছে না। নগর দরিদ্রের দিকে বাজেটে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার বলেন, আগামী বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ হলো একই সাথে রাজস্ব, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়াতে হবে।
পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে, ডলার সঙ্কট দূর করার উদ্যোগ থাকতে হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ ডলার সঙ্কট সমাধানের উপায় হতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো ঠিক না। সরকার অনেক জায়গায় ব্যয় কমাতে পারে। এডিপিতে এতো ১,৫০০ প্রকল্প কেন? মোটা চাল সরুকরণ প্রকল্প নেয়া হয়। এগুলো তো বেসরকারি খাতের কাজ।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ম্যাক্রো ইকোনমি স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কোভিডকালীন সময় থেকে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে, যা দূর করতে আগামী বাজেটে পদক্ষেপ থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডে ব্যাংক ধস নতুন করে বৈশ্বিক আর্থিক সঙ্কটের সঙ্কেত দিচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে সতর্ক থেকে বাজেট প্রণয়নের পরামর্শ দেন তিনি।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।