স্টাফ রিপোর্টার: সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ধ্বংসে কোম্পানিটির পদচ্যুত সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ পাঁয়তারা শুরু করেছে। যারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সাধারন শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। অথচ কোম্পানিটির বর্তমান ম্যানেজমেন্টের হাত ধরে ব্যবসা এগিয়ে যাচ্ছে।
যাতে করোনা এবং এর পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের মধ্যেও সিমেটেক্সের মুনাফা হয়েছে এবং ৮% লভ্যাংশ দিয়েছে। এই অবস্থায় কোম্পানিটিকে রক্ষায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সহযোগিতা প্রত্যাশা করে সিমটেক্স কর্তৃপক্ষ।
বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের হাত ধরে সিমটেক্স এগিয়ে গেলেও কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান তাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। দুর্নীতি ও অনিয়মের কারনে চেয়ারম্যানের পদ হারিয়ে তিনি এখন ক্ষুব্ধ। যে কারনে তিনি গত বছরের ৩১ আগষ্ট কোম্পানির কারখানায় ভাড়া করা সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সশস্ত্র হামলা করে কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের মারাত্মকভাবে জখম করে ব্যবসায়ীক অগ্রগতি থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ আছে। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান।
তারপরেও পদচ্যুত সাবেক চেয়ারম্যানের অভিযোগের আলোকে বিএসইসি সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের পর্ষদ পূণ:গঠনের কথা ভাবছে বলে জানা গেছে। যেখানে ৫ জনের বিশাল আকারের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে চায়। যে তালিকায় কমিশন শেখ মামুন খালেদকে স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিতে চাচ্ছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে আছে নানা অভিযোগ।
যার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, অবৈধ লোভলালসা, অতিলোভী ও বহুরূপীর অভিযোগ আছে। যার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও আছে। তাকে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা চেনেন দুর্নীতিতে ভাগ বসানোকারী হিসেবে। অন্য সাধারণ বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা চেনেন বড়ো চাঁদাবাজ হিসেবে।
এই অবস্থায় সাবেক চেয়ারম্যানের অসত্য ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগের আলোকে সিমটেক্সের পর্ষদ পূণ:গঠন কতটা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করবে, তা ভেবে দেখার দরকার। কোম্পানির বৃহত্তর স্বার্থে কমিশন বিষয়টি পূনঃবিবেচনা করে দেখবে বলে আশা সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষের।
অথচ সিমটেক্স ইন্ডাষ্ট্রিজে চাকুরী করে মালিকের দেয়া ২% শেয়ার পেয়ে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন আনিসুর রহমান। যার বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট করে চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার অভিযোগ আছে। যে পদ হারানোর ক্ষোভে কারখানা আক্রমনে এসে নানা মামলার আসামী জামিন পেয়ে কোম্পানীর স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন।
তার বিরুদ্ধে এখন বেশ কিছু মামলা চলমান। এরমধ্যে সরকার বাদী (বাংলাদেশ পুলিশ) হয়ে মামলা রজু করে (সাভার মডেল থানার মামলা নং-০৪, তারিখ ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ধারাঃ ১৯অ/১৯(ভ) ১৭৭৮ সালের অস্ত্র আইন)।
এছাড়া সিমটেক্স ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃক দায়ের করা মামলা (সাভার মডেল থানার মামলা নং-০৩, তারিখ ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ধারাঃ ১৪৩/৪৪৭ /৪৪৮/৩২৩/ ৩২৫/৩২৬/ ৩০৭/১১৪/ ৫০৬/৩৪ পেনাল কোড), কারখানায় হামলায় গুরুত্বরভাবে আহত রিপন শেখ এর পরিবারের দায়েরকৃত মামলা (ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত, বাগেরহাট মিস কেস নং ২৯০/২২) এবং সিমটেক্স ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃক দায়ের করা আর্থিক জালিয়াতি/দূর্নীতি মামলা (যুগ্ন জেলা জজ আদালত, ঢাকা মামলা নং ০৭/২৩ তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) চলমান।
কমিশন শেখ মামুন খালেদের সঙ্গে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সুবোধ দেবনাথ, দ্যা জুরিস্ট ঢাকা বাংলাদেশের পাটনার কাওসার আহমেদ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল কাইয়ুম, ব্যবসায়ী আবিদ আল হাসানকে নিয়োগ দিতে চায়। কিন্তু একটি কোম্পানিতে ৫ জন স্বতন্ত্র পরিচালকের নিয়োগ কতটা যৌক্তিক, তার প্রশ্ন থেকেই যায়। এতে না কোম্পানিরই ক্ষতি হয়ে যায়। যাতে করে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে শেয়ারহোল্ডাররা।
কিন্তু ২০১৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ নিয়মিত মুনাফা অর্জন ও শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। প্রায় ৮০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটি করোনা কাটিয়ে উত্থানের পথে।
এরইমধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরের ৪ শতাংশ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে দ্বিগুণ বা ৮% নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এছাড়া অন্যসব কোম্পানি যখন বোনাস শেয়ার ধরিয়ে দিতে চায়, তখন সিমটেক্স প্রতিবছর নগদ লভ্যাংশ দিয়ে আসছে।
এ বিষয়ে সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কোম্পানির এজিএমে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে সরাতে বিএসইসিকে প্রভাবিত করা হয়েছে। এখন যাদেরকে দেওয়া হয়েছে- তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এতে কোম্পানি ও সাধারণ শেয়ারহেল্ডারদের ক্ষতি হবে। তারা কোম্পানির দায়িত্ব নিলে, মালিক পক্ষ উৎপাদনে থাকতে পারবে না। আর তখন ব্যাংক টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিবে। এতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
ওই কর্মকর্তা দাবি করন- আনিসুর রহমান চক্র প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিক ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে। বন্ধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা দখলে আসলে চালাতে পারবে না। কারন তাদের সেই অধিকার নাই। সাধারণ শেয়ারহোল্ডার তাদের সেই অধিকার দেয় নাই।
সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে হামলার ঘটনার বিবরণ –
গত বছরের ১৭ আগষ্ট অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় কোম্পানিতে নানা অনিয়মের কারণে লে. ক. (অব.) মোঃ আনিসুর রহমানকে চেয়ারম্যানের পদ হতে অব্যহতি প্রদানের জন্য স্বতন্ত্র পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মো. সরোয়ার হোসেন-এর নাম নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে প্রস্তাব করে। যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আনিসুর রহমান চেয়ারম্যান হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় ই-মেইল দিয়ে কোম্পানিকে সহযোগীতা না করার জন্য অনুরোধ করেন বলে বর্তমান পর্ষদের অভিযোগ।
এছাড়া কোম্পানির ক্ষতি করতে চেয়ারম্যানের পদ হারানো আনিসুর রহমান সিমটেক্সের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়াজ রহমান সাকিবের বিরুদ্ধে ২ (দুই) টি মিথ্যা ও বানোয়াট সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেন বলে অভিযোগ আছে। যাহার একটি সাভার মডেল থানায় ও অন্যটি মিরপুর পল্লবী থানায়। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির পর থেকে আনিসুর রহমান কারখানার কার্যক্রম বিঘ্নিত করতে ব্যাংক, বিএসইসি, এসিসি, কাস্টমস, চিটাগাং পোর্ট ইত্যাদি জয়গায় মিথ্যা, বানোয়াট ও অসত্য তথ্য সরবরাহ করেন। এর মাধ্যমে কোম্পানির ৫-৬ শেয়ারহোল্ডারের ক্ষতি করার চেষ্টা করেন।
আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে গত বছরের ৩১ আগষ্ট ১৮ থেকে ২০ জন অস্ত্রধারী ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা ফ্যাক্টরীতে আক্রমণ চালায় বলে সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষের অভিযোগ। এ সময় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা অফিস কমপ্লেক্সসহ কারখানা ও মেইন গেইট দখলে নিয়ে ব্যাপক তান্ডব চালায় ও কর্মর্কতা-কর্মচারীদেরকে হত্যার হুমকী দেয়। সন্ত্রাসীরা শ্রমিকদের অতর্কিতভাবে বেধরক মারপিট করে এবং শ্রমিকদের উপর গুলি বর্ষণ করে।
এতে কারখানার ফ্লোর ইনচার্জ রিপন শেখ, ড্রাইভার রফিক, ট্রান্সপোর্ট অফিসার জাহাঙ্গীর, সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) শ্রীনিবাসা রাও তাল্লোরী (ইন্ডিয়ান কর্মকর্ত) আহত হন। এদের মধ্যে রিপন শেখ সন্ত্রাসীদের গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হওয়ায় তাকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং অদ্যাবধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে এবং অন্যান্যদের সাভারের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়েছিল।
যে আক্রমণের সংবাদ পেয়ে সাভার থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছায়ছিল এবং পাঁচটি শটগানসহ ৩৭ রাউন্ড গোলাবারুদ, একটি বিদেশী পিস্তলসহ আনিসুর রহমান এবং মোট ৮জন সন্ত্রাসী ও একটি মাইক্রোবাস ও অন্যান্য সরঞ্জাম ও অস্ত্রসস্ত্র জব্দ করেন। এ সময় ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পুলিশ, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটিলিয়ন, সাংবাদিকগণসহ বিভিন্ন এজেন্সির প্রতিনিধিগণ ঘটনাস্থলে আগমন করেন এবং তাদেরকে থানার জিম্মায় নিয়ে যায়।
এরপরে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর মোঃ আনিসুর রহমান জামিনে মুক্ত হয়ে সাভার মডেল থানায় আবারও একটি মামলা দায়ের করার জন্য প্রচেষ্টা চালান। তবে থানা মামলা নিতে সম্মতি না হলে সিজেএম কোর্ট থেকে মিথ্যা অযুহাতে এফআইআর করেন। যেখানে কোম্পানীর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক নিয়াজ রহমান সাকিব, হেড অফ কর্পোরেট এ্যাফেয়ার্স জনাব মোঃ জাহিদ, কোম্পানীর সেক্রেটারী আশিষ কুমার সাহা ও কোম্পানীর সহকারী ম্যানেজার পরিমল চন্দ্র পালকে আসামী করা হয় ।
আনিসুরের বিরুদ্ধে কোম্পানি থেকে অবৈধভাবে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও আছে। তিনি আইন কানুন ও রিজুলেশন বা বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই কোম্পানি থেকে ৫ লাখ টাকা বেতন, ২টি গাড়ী, ড্রাইভার ও আনুসাঙ্গিক সুবিধা নিতেন।
এছাড়া আনিস তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিদেশ ভ্রমন ভাতা কোম্পানী থেকে পরিশোধ করতেন, তার নিজের ও পরিবারের সদস্য বর্গের আয়কর রিটার্ন কোম্পানী থেকে পরিশোধ করতেন, ব্যাংকের ষ্টেটমেন্ট জালিয়াতি করে আয়কর রিটার্ন জমা করতেন, কোম্পানীর বিশ্বস্ত ও পরিশ্রমী কর্মচারীদের বিদায় করে নিজস্ব লোকদের নিয়োগ দিতেন এবং তাদের বেতন-ভাতাও নির্ধারন করে আনুসাঙ্গিক সুবিধা নিজের মত কারখানা চালাতেন।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আনিসুর রহমান বলেন, সিদ্দিকুর রহমান কোম্পানির এমডি ছিলেন। পিকে হালদারের সঙ্গে দুর্নীতির করে এখন বিদেশে পালিয়ে আছে। দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে অনেক মামলা করেছে। তার ছেলের বিরুদ্ধেও মামলা আছে। কিন্তু তার ছেলে দেশে ফিরে এখন লোকবল ঠিক করে কোম্পানি দখলের চেষ্টা করছে। আমার বিরুদ্ধে মিথ্য মামলা করছে। প্রতিকারে আমিও মামলা করেছি।
তিনি বলেন, মূল কথা হলে- তাদের লুটপাটে বাধা দেওয়ায় আমাকে সরিয়ে দিয়েছে। এখন তারা নিজেরা সমস্যায় পড়ে দায় আমার উপর চাপাচ্ছে। পাবলিক কোম্পানির অনিয়ম দেখার দায় দায়িত্ব বিএসইসির। তারা দেখেছেন- পদক্ষেপ নিয়েছেন, এর মধ্যে আমি আসবো কেন। তাদের কিছু বলার থাকলে কমিশনকে বলবে। আমার নামে মিথ্যাচার করে কিছু হবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।