এক বছরে সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাবই হচ্ছে একটি দেশের বাজেট। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সেই বাজেটেই রয়েছে যত সংকট। একদিকে বৈরী আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, অপরদিকে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরি ও বাস্তবায়নে থাকছে ঝুঁকি। অর্থাৎ বর্তমান সরকার বাজেটটি তৈরির করলেও এর একটি অংশ বাস্তবায়ন করবে চলতি সরকার, মাঝের একটি অংশ নির্বাচনকালীন সরকার এবং শেষ অংশ বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী সরকার। তাই নতুন বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে নানান দিক নিয়ে ভাবতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।
একদিকে জনতুষ্টি, আরেক দিকে বাস্তবতা। কোন দিকটিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবারের বাজেটে। এ রকম নানান বিষয় নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।
ড. শামসুল আলম: আগামী বছর অর্থনীতিতে নানা চাপ থাকবে। সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কমানো, ডলার সংকট মোকাবিলা, উন্নয়ন প্রকল্পের গতি বাড়ানোসহ নানা চ্যালেঞ্জ আছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ভারাসাম্য রক্ষা ও নানামুখী ঝুঁকি মোকাবিলাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।
ড. শামসুল আলম: নির্বাচন একটি শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। সেটি সময় মতো অনুষ্ঠিত হবে। এর সঙ্গে বাজেটের কোনো সম্পর্ক নেই। এবারও নির্বাচনের সঙ্গে বাজেটের কোনো সম্পর্ক থাকছে না। সরকার চেষ্টা করছে অর্থনীতি যাতে সঠিক পথে পরিচালিত হয়। কোনো কারণে যেন অর্থনীতি ভেঙে না পড়ে। তবে এটা স্বাভাবিক যে, অনেক সময় বাজেটে নির্বাচনি প্রভাব থাকে। এবার যুবকদের প্রশিক্ষণসহ জনতুষ্টির বাজেট হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা সেটি করছি না। নির্বাচনের স্বার্থে বাজেটে প্রচুর ব্যয়ের লোভ দেখানো হচ্ছে না। এটি করলে দেশের অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়বে। সরকার সেটি করছে না। অর্থনীতি রক্ষা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্য থাকছে আগামী বাজেটে।
ড. শামসুল আলম: না, সরাসরি ভোটার তুষ্টির কোনো বিষয় বাজেটে থাকবে না। তবে বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো মূল্যস্ফীতি। এটা যাতে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সে বিষয়ে নানা পদক্ষেপ থাকবে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরলে সেটির প্রভাব পড়বে নির্বাচনে। বাজেটে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নেও সরকারের বিশেষ নজর আছে। সবকিছু মিলিয়ে আসছে বাজেট জনগণের জন্যই।
ড. শামসুল আলম: ইতোমধ্যেই সরকারের ভর্তুকি অনেক বেড়ে গেছে। ডিজেল, সারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকিতে বেশ মোটা অংকের টাকা লাগছে। সরকারকে ব্যাংক ও বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ফলে বাজেট বড় করার সুযোগ নেই। সেইসঙ্গে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হচ্ছে না। এর যৌক্তিক কারণও আছে। করোনা মহামারি এবং পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক কমে গেছে। বিনিয়োগ প্রায় থেমে ছিল। আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে রাজস্ব কম এসেছে। এসব কারণে গত অর্থবছর এই সময় যেখানে রাজস্ব আদায় ১৬ শতাংশ ছিল এবং সেটি ১১ শতাংশে নেমে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাজেট দেওয়া যায়নি। চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট কিছুটা বাড়বে। সেটি খুব বেশি নয়। বলা চলে বাস্তবতার ভিত্তিতেই বাজেট তৈরি করা হচ্ছে। দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়েই বাজেট অনেক বড় করা যায়নি।
ড. শামসুল আলম: যেসব প্রকল্প কর্মসংস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখবে সেগুলোতে গুরুত্ব দিয়েছি। কোভিড-১৯ এর কারণে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষা খাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আগামী বাজেটে। আগেই বলেছি, কৃষি প্রকল্প গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের বোরে ধান চমৎকার হয়েছে। শাক-সবজির উৎপাদন ভালো হয়েছে। এসব মূল্যষ্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে। প্রয়োজনে আমরা আমদানির সুযোগ দেব। যেমন পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। তাই পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। চালের দাম স্থিতিশীল আছে। পণ্যমূল্য যাতে সহনীয় থাকে সেজন্য আগামী বাজেটে ব্যবস্থা থাকবে। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাত সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন ভাতা বৃদ্ধি পাবে। সরকারের লক্ষ্যই হলো জনগণকে স্বস্তি দেওয়া। সেজন্য বাজেটে যা করলে সাধারণ মানুষের জন্য মঙ্গলজনক হবে তাই করা হচ্ছে।
ড. শামসুল আলম: পরিকল্পনা কমিশন এখন অনেক বেশি সচেতন। চাইলেই যেকোনো প্রকল্প এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) ঢোকার সুযোগ নেই। ব্যাপক যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রকল্প অন্তর্ভুক্তি কিংবা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আগামী অর্থবছর। প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ে অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে এখন। যদিও এটা একটা অপ্রীতিকর কাজ। তবুও প্রস্তাবিত ব্যয়কে যুক্তিযুক্ত করা হচ্ছে। এছাড়া ভবন নির্মাণসংক্রান্ত প্রকল্পে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ করে প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে।
ড. শামসুল আলম: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে মার্কিন ডলারের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। কমে যায় টাকার মান। এ অবস্থায় আাদের দেশে ইট, পাথর, সিমেন্ট, বিটুমিনসহ সবধরনের নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে। আগে যেমন ৬০ গ্রেডের এক টন রডের দাম ছিল ৬৪ হাজার টাকা। সেটি হঠাৎ করেই বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ টাকায়।
আমাদের এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই ভৌত অবকাঠামো সংক্রান্ত। ঠিকাদাররা তাই কাজ বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্রসহ প্রয়েজনীয় সব জিনিসের দামই বেড়ে যায়। ঠিকাদাররা যখন দরপত্র অনুযায়ী কাজ পায় তখন ভাবতেও পারেনি যে দাম এত বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে দাম নির্ধারণ করা হয়। এতে বেশ খানিকটা সময় চলে যায়। এ সব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি ছিল।
ড. শামসুল আলম আপনাকেও ধন্যবাদ
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।