বিশেষ প্রতিনিধি: ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানকে ঋণ, তথ্য গোপন, খেলাপি নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে উত্তরা ব্যাংক লিমিটেডের বিরুদ্ধে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকির মুখে ফেলেছে বেসরকারি এই ব্যাংকটি। ঋণ ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়মে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকরা জড়িয়ে পড়েছেন।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান প্রভাব খাটিয়ে ভাইয়ের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার ঋণ দিয়েছেন। সেই ঋণ খেলাপি হওয়ার পরও বারবার পুনঃতফসিলের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ঋণটি নিয়মিতকরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত কিস্তি পরিশোধের নির্দেশনাও মানেনি উত্তরা ব্যাংক।
বেনামি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অবৈধ সুবিধা নেওয়া, চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে গাড়ি কেনাসহ নানা অনিয়মের কারণে ইতিমধ্যেই আলোচনায় রয়েছে বেসরকারি উত্তরা ব্যাংক। বরাবরের মতোই বিভিন্ন খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দিচ্ছে এই ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ঋণ অনিয়মের এই কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন একসময়ের দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলামের দুই ভাই আজহারুল ইসলাম ও সফিউল ইসলাম। আজহারুল ইসলাম আফতাব গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান। আর তার ভাই সফিউল ইসলাম নাভানা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা, যে গ্রুপটি রিয়েল এস্টেট, আবাসন, নির্মাণ ও অটোমোবাইল ব্যবসায় জড়িত। উত্তরা ব্যাংকে ইসলাম পরিবারের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সফিউল ইসলাম তার পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘বিপনণ’ লিমিটেডের নামে উত্তরা ব্যাংক থেকে দুই দফায় ৩০ কোটি টাকা ঋণ নেন। অবশ্য ঋণ নেওয়ার এক মাস আগেই সফিউল ইসলাম ‘বিপনণ’-এ থাকা তার শেয়ার স্ত্রী খালেদা ইসলামের নামে হস্তান্তর করে চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
২০১৮ ও ২০১৯ সালে ঋণ নিলেও তা পরিশোধ না করায় খেলাপি হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শনে গেলে ‘বিপনণ’ নামক প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। এমনকি ‘বিপনণ’র কোনো কার্যক্রমও তাদের চোখে পড়েনি।
এমন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারছে না নাভানা গ্রুপ। বর্তমানে পুঁজিবাজারে নাভানা গ্রুপের অধীন আফতাব অটোমোবাইল ও নাভানা সিএনজি লিমিটেড নামে দুটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। আর এই দুই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ভিত্তি কয়েক বছর ধরেই দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলকে ঋণ হিসাবটির আদায় অগ্রগতি, অনুমোদন প্রক্রিয়া যাচাই করতে ২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৩-এর পরিচালক নির্দেশনা দেয়। ওই বছরের ১০ অক্টোবর পরিদর্শন দল ও শাখা ব্যবস্থাপকসহ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ওই প্রতিষ্ঠানটিতে সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তারা প্রতিষ্ঠানটির কোনো অফিস এবং প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যক্রমও খুঁজে পাননি।
পরিদর্শন দলের কাছে প্রতিষ্ঠানটি একটি কাগজে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ঋণ অনিয়মের বিষয়ে জানতে উত্তরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রবিউল হোসেন এবং চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তারা সাড়া দেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো জবাব মেলেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. জাকির হোসেন চৌধুরী বলেন, বেনামি বা অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া আইনের লঙ্ঘন। কোনো ব্যাংক যদি এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন তাহলে অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ তদন্ত করে দেখবে। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, সফিউল ইসলাম ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে ‘বিপনণ’ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘদিন ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে ছিলেন তার ছেলে শরিফুল ইসলাম, খাদেজা ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, সাজেদুল ইসলাম ও ফারহানা ইসলাম। কিন্তু হঠাৎ করে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর সফিউল ইসলাম ‘বিপনণে’ থাকা তার মালিকানাধীন ছয় হাজার শেয়ার স্ত্রী খালেদা ইসলামের কাছে হস্তান্তর করে চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এরপর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান খালেদা ইসলাম। হস্তান্তরের এক মাস পার না হতেই ওই বছরের ১৫ নভেম্বর উত্তরা ব্যাংকে একটি সিডি (ক্রেডিট ডিপোজিট) হিসাব খোলে কোম্পানিটি। আর ২৬ ডিসেম্বর ‘বিপনণ’ লিমিটেডের নামে ১৫ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়। পরে কোম্পানিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২ ডিসেম্বর ঋণের পুরো অর্থ একসঙ্গে বিতরণ করে উত্তরা ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই ঋণের বিপরীতে ১৫ কোটি টাকার জমি জামানত নেওয়া হলেও ভ্যালুয়ার কোম্পানি (সম্পদের মূল্য নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান) মেসার্স গ্লোবাল সার্ভে অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মূল্যায়নে ওই জমির দাম অর্ধেকেরও কম।
ভ্যালুয়ার কোম্পানির ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের মূল্যায়নে জামানত হিসেবে দেওয়া দুটি জমির বাজারমূল্য ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা এবং তাৎক্ষণিক মূল্য ৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির জোনাল হেডের কোনো সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। আর প্রতিষ্ঠাটির সঙ্গে পরিচালকদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না তার তথ্যও উপস্থাপন করা হয়নি।
‘বিপণন’ লিমিটেডের ঋণ হিসাবটিতে সুদ আরোপের সমপরিমাণ আদায় না থাকলেও ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ উত্তরা ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটিকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বাবদ আরও ১৫ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করে। এই ঋণের ক্ষেত্রেও নেওয়া হয়নি জোনাল হেডের সুপারিশ। প্রতিষ্ঠাটির সঙ্গে পরিচালকদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না তার তথ্যও উপস্থাপন করা হয়নি।
২০২০ সালের আগস্ট মাসে ‘বিপণন’ লিমিটেডের প্রথম নেওয়া ১৫ কোটি টাকার ঋণ গুণগতমানের ভিত্তিতে খেলাপি ঘোষণা করায় প্রথম পুনঃতফসিল অনুমোদন করা হয়। কিন্তু ঋণের হিসাব দুটিতে কোনো আদায় না থাকায় এই ঋণ আদায় অযোগ্য খেলাপি করা হয়। এরপর ২০২১ সালে ১১ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ১৮ লাখ ৭৮ হাজার টাকা ও প্রথম পুনঃতফসিলকৃত মেয়াদি ঋণে ১০ লাখ ২২ হাজার টাকা নিয়ে দ্বিতীয় পুনঃতফসিল মঞ্জুর করা হয়, যা কার্যকর করার জন্য ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করে। পরে ২০২১ সালের ৮ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মাধ্যমে পুনঃতফসিল অনুমোদন করা হয়।
পুনঃতফসিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ‘বিপনণ’র সমহারে কিস্তি নির্ধারণ না করে বিশেষ সুবিধা দেয়। ২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাসিক ১০ লাখ টাকা করে এবং পরে মাসিক ৬৮ লাখ ৭ হাজার ৫৫০ টাকা কিস্তি নির্ধারণ করে উত্তরা ব্যাংক, যা ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং বিআরপিডির নির্দেশনার লঙ্ঘন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনা বলছে, ঋণ আবেদনের সময় ‘বিপনণ’ নামে প্রতিষ্ঠানটির ক্রয় ১৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা, বিক্রয় ২১ লাখ ৭২ হাজার টাকা, নিট ক্ষতি ১১ লাখ ২৩ হাজার টাকা দেখানো হয়। এ সময় দায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ও সম্পদ ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা দেখানো হয়। এমন দুর্বল আর্থিক ভিত্তি উপস্থাপনের পরও কোম্পানিটিকে ৩০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়, যা ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কমিটি।
এমন পরিস্থিতিতে অনিয়মসহ ও সরেজমিন পরিদর্শনে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অফিস ও কোনো কার্যক্রম না পাওয়ায় ঋণ হিসাব দুটি মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণীকরণ করা হয়। পাশাপাশি নির্দেশনা লঙ্ঘন করায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান এবং ঋণ হিসাব যথাযথ মানে শ্রেণীকরণ, সংস্থান সংরক্ষণ ও সিআইবি রিপোর্টসহ অবহিত করতে বলা হয়।
এদিকে, উত্তরা ব্যাংক অন্তত ৪৫টি প্রতিষ্ঠানের ১০৫ কোটি টাকার ঋণ আদায় অগ্রগতি না থাকা এবং দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ ও সীমাতিরিক্ত অবস্থায় থাকার পরও খেলাপি হিসেবে দেখায়নি। পরে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের দৃষ্টিতে এলে মেয়াদোত্তীর্ণ ও গুণগতমানের ভিত্তিতে ঋণগুলো ক্ষতিজনক মানে খেলাপি দেখানের নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি এসব ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিকে অবহিত করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, ব্যাংকের চেয়ারম্যানের প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনি কতগুলো নিয়ম রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান হচ্ছে, ব্যাংক চেয়ারম্যান ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নন-ফান্ডেড লোন নিতে পারবেন।
এ ছাড়া তিনি যে পরিমাণ শেয়ার ধারণ করেন তার ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন। তবে সেটা বোর্ডের অনুমতি সাপেক্ষে। এ ক্ষেত্রে অনুমোদন হওয়া বোর্ডসভায় তিনি উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি নীতিমালা রয়েছে, যেখানে উল্লেখ আছে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আট শ্রেণির বাইরে যদি হয় তাহলে চেয়ারম্যান বা পরিচালক তার দায় নেবেন না। আট শ্রেণির মধ্যে রয়েছে, পরিচালক, তার ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, শ্বশুর এবং শাশুড়ি। এর বাইরে কেউ হলে তার দায় পরিচালকের নয়।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।