স্টাফ রিপোর্টার: গ্রাহকদের জমা টাকার সুরক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে আমানতের ১৩ শতাংশ অর্থ বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। আর তা সংরক্ষণ করতে হয় সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ড কেনার মাধ্যমে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৮ জুন পর্যন্ত টানা সাড়ে ৯ মাস বিভিন্ন সময় এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি। ফলে বিশাল অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়েছে।
ব্যাংকটিকে এখন পর্যন্ত ২২১ কোটি টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বোর্ডের পরিচালকদের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ন্যাশনাল ব্যাংক গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ৪৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকার এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হয় এবং পরে আরো প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকটির এসএলআর বাবদ ৫ হাজার ৫৩২ কোটি ২৭ লাখ টাকা সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও মাত্র ২ হাজার ১৫৫ কোটি ২১ লাখ টাকা রাখতে সক্ষম হয়। ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকটি মাত্র ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাখতে সক্ষম হয়।
ফলে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঘাটতিতে পড়ে যায় বা রাখতে ব্যর্থ হয়। আর ৩১ মে ব্যাংকটির এসএলআর বাবদ ৫ হাজার ৩২৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকটি মাত্র ৮৮২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা রাখতে সক্ষম হয়। ওই দিন ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা।
আর সর্বশেষ ১৮ জুন ব্যাংকটির এসএলআর বাবদ ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকটি মাত্র ৭৮৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা রাখতে সক্ষম হয়। ওই দিন ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
প্রায় সাড়ে ৯ মাস বিভিন্ন সময় এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিপুল অঙ্গের জরিমানা করে ন্যাশনাল ব্যাংককে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৩১ অক্টোবরের এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে দুই মাসের জন্য ১১ কোটি ৭ লাখ ৪৮ হাজার ৯১০ কোটি টাকা জরিমানা করে। আর পরবর্তী দুই মাসের (নভেম্বর-ডিসেম্বর) জন্য ৩৩ কোটি ৯৯ লাখ ৮৬ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৬ কোটি ৬৪ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ২৭ কোটি ৫৬ লাখ, মার্চে প্রায় ৩৪ কোটি এবং এপ্রিল মাসে ৩০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
মে ও জুন এই দুই মাসের জরিমানাসহ গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৩ জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি ২২১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা জরিমানার সম্মুখীন হয় বলে ব্যাংকটির প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। আর জানুয়ারি-মে পর্যন্ত জরিমানার পরিমাণ ১৭৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক মার্চ পর্যন্ত জরিমানার অর্থ ব্যাংকটির ক্লিয়ারি অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নিয়েছে বলে সূত্রে জানা যায়।
তবে তারল্য সংকটে থাকার কারণে এপ্রিল মাসের জরিমানার অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকটি। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জরিমানার অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য বাড়তি সময় চেয়েছে। আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এ সময় চাওয়া হয়। একই সঙ্গে জরিমানার অর্থ মওফুক চেয়েও চিঠি দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এর কোনো প্রত্যুত্তর দেয়নি। তবে দণ্ডসুদ মওকুফ সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এই ক্ষমতা কেবল সরকারের রয়েছে।
জানা যায়, ব্যাংকটি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৩৮৬ কোটি ৭২ লাখ টাকার আমানত হারিয়েছে। একই সময় ৫২ কোটি ৭৮ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। এছাড়া ঋণ, খেলাপি ঋণ, আমদানির ফোসর্ড লোন ও রাইট-অফ থেকে আদায় অবস্থা দুর্বল।
ফলে ব্যাংকটির চরম আকারে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে এসএলআর বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকটি। গত বছর মিডিয়ার বিরূপ প্রতিবেদনের কারণে ব্যাংক আমানত উত্তোলনের চাপের সম্মুখীন হয়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ্য করা হয়েছে। গত ১৮ জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) ২৫ দশমিক ২৪ মিলিয়ন নেগেটিভ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেহমুদ হোসেনের সঙ্গে গত ২১ জুন মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করে ১০ মিনিট পর কল দেয়ার জন্য বলেন। এরপর একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার মেসেজ করা হলেও কোনো সাড়া দেননি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, গত বছর থেকে ব্যাংকটি তারল্য সংকটে ভুগছে। এর ফলে গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসে এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকটি। এখনও ব্যাংকটিতে তারল্য সংকট চলছে। এজন্য জরিমানার অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সময় চেয়ে চিঠি দিয়েছে ব্যাংক।
সূত্রমতে, ন্যাশনাল ব্যাংক মাত্র কয়েক বছর আগে দেশের অন্যতম স্বনামধন্য ব্যাংক ছিল। তবে সম্প্রতি সময়ে নামে-বেনামে ঋণ ও নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ডেফারেল সুবিধা দেয়া হয় ব্যাংকটিকে। সুবিধা পেয়ে আর্থিক অবস্থার উন্নতি দেখাতে পারেনি। বরং গত বছর রেকর্ড পরিমাণ লোকসান গুনে বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটি।
গত বছর ৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা লোকসান দেয় ন্যাশনাল ব্যাংক। মূলত ঋণ থেকে ইন্টারেস্ট ইনকাম না হওয়া এবং ঋণের টাকাও আদায় করতে না পারায় ব্যাংকটির আয় কমে গেছে। আর ব্যাংকটির এলসি বাণিজ্য তেমন না থাকায় কমিশন ইনকাম হয়নি।
এছাড়া ব্যাংকটি ২০২২ সালে ২ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করেছে গ্রাহকদের। এসব সুদ গত বছরগুলোয় ব্যাংকটি তাদের আয়ের হিসেবে দেখিয়েছিল। আবার মুনাফা থেকে সরকারকে করও পরিশোধ করেছে। মুনাফাও বিতরণ করেছিল। এখন সুদ মওকুফ করায় ব্যাংকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য হিসাব থেকে এই অর্থ সমন্বয় করতে হচ্ছে। ফলে বড় অঙ্কের লোকসানে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা খেলাপি, যা মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। মার্চ শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ প্রভিশন ঘাটতির ফলে ব্যাংকটি মূলধন ঘাটতিতে পড়ে। গত মার্চ শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।