‘আর্থিক সেক্টরের কোনো প্রতিষ্ঠান ভালো নেই। সেগুলো হয়তো লোকসান দিচ্ছে নতুবা ঋণাত্মক। তা না হলে গ্রাহকের আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। আর বিমা খাত নামে টিকে আছে। বিমা কোম্পানিগুলো হাজারো দুর্বলতা নিয়ে ধুঁকছে।’
বিমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থায় যিনি এসে বসেন, তিনি এক দিনেই কি রোগ চিনবেন? আর কী-ই বা ওষুধ দেবেন। কাজেই রোগ আছে কিন্তু ওষুধ নেই। সেজন্য বলি বিমা কোম্পানি ভূতে চালায়’ এসব কথা বলেন মো. মানসুর আলম শিকদার।
একাধারে তিনি একজন লেখক এবং বিমা বিশ্লেষক। ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের বিমা অগ্রগতিতে কাজ করছেন। বর্তমানে তিনি রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত আছেন। বিমা খাতের বিভিন্ন দুর্বলতা এবং আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর খারাপ দিক নিয়েও অকপটে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন তথ্য।
রাজধানীর কাকরাইলে এইচআরসি ভবনে কোম্পানির নিজস্ব কার্যালয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- শাহীনুর ইসলাম।
মানসুর আলম শিকদার : নীতিহীন বাণিজ্য। যে কোনো বিভাগের জন্যই এটি মারাত্মক। একটি বিমা কোম্পানিকে কোন বিভাগ বা কে চালায়- আমরা কতজনে জানি। বিমা কোম্পানিতে আন্ডাররাইটার নামে একটি বিভাগ রয়েছে, যারা নীতি এবং পলিসি নিয়ে কাজ করে। তারা কোম্পানির বড় কোনো পদে যেতে পারেন না বা তাকে সুযোগও দেয়া হয় না। কারণ এখানে মার্কেটিং লেভেলের অল্পশিক্ষিত কিছু লোককে হায়ার করে এনে বসানো হয়। যারা ব্যবসা দিতে পারবেন, তারাই হবেন কোম্পানির এমডি, ডিএমডি। বড় পদে তারাই বসবেন।
যাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠেও যায়নি। বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থাও সেই মার্কেটিং লোকদের নিয়ে আলোচনা করেন। কোনো সাংবাদিক কথা বলতে চাইলে কোম্পানির কোনো পলিসি নিয়ে; তাদের সঙ্গেই বলেন। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) প্রধান হিসেবে যিনি সরকার থেকে নির্দিষ্ট সময়ে জন্য আসেন, তিনিও এতটা ঝামেলা পোহাতে চান না। সময় পেরিয়ে গেলে তিনিও চলে যান। তাহলে ফলাফল কী?
মানসুর আলম শিকদার : কারণ অনেক আছে। বাংলাদেশের আর্থিক সেক্টরের কোনো প্রতিষ্ঠান ভালো নেই। ব্যাংক ছাড়া আর্থিক সেক্টরের ২৬টি প্রতিষ্ঠান ভয়াবহ লোকসানে বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ব্যাংকগুলোর কী অবস্থা? এর দায় কি শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের? না, দায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের। এটি সরকারের একটি ব্যর্থ মন্ত্রণালয়। যার দায় বহন করেন অর্থসচিব।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন কাগুজে স্বায়ত্তশাসিত একটি প্রতিষ্ঠান, চালায় অর্থ মন্ত্রণালয়। সেখানে পলিসি মেকার ভালো নয়; তার কারণে এই সমস্যা সব খাতে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ঠিক তো, দেশের সব প্রতিষ্ঠান ঠিক। সঠিকভাবে নীতি সহায়তা দেয়া হলেই রুগ্ণ থেকে সুস্থতায় ফিরবে।
এখানে আমি বলব- আমি আইন ও ব্যবসা বিষয়ে পড়ালেখা করেছি এবং ৩০ বছর ধরে বিমা নিয়ে কাজ করছি। কাজেই আমাকে বিমা বিষয়ের কাজে আমাকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। আর যার যা নেই, তাকে সে বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া মানেই- ক্ষতির জন্য প্রস্তুত থাকা। আর্থিক সেক্টরে তাই হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান ভালো নেই। ইতোমধ্যে আমাদের জিডিপি, এসডিজি, মাথাপিছু ঋণ- সব খাতে ভয়াবহ।
আমাদের বৈদেশিক ঋণ, অভ্যন্তরীণ সব বেড়েছে। বাজেট ঘাটতি কিন্তু কমেনি, সেও বেড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় নয়, ব্যর্থ মন্ত্রণালয়। শেখ হাসিনা চেষ্টা করছেন, তার চেষ্টাকে আমরা স্বাগত জানাই। তিনি আমাদের নেত্রী। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ে যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকের যে ভীষণ অভাব।
মানসুর আলম শিকদার : ‘সাধারণ বিমার মূলতত্ত্ব’ নামে একটি বই আছে। ৩০ বছরে বিমা খাতে কাজ করেছি। এটিই প্রথম বাংলা ভাষায় লিখিত বই। মূল বই বাজারে এখন পাবেন না। খিলক্ষেতে পুরনো বইয়ের দোকানে ফটোকপি পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে সংগ্রহ করে। আমার কাছে মূল কপি ৭-৮টি আছে। নতুন আইন ও সংস্কার করে আগামীতে কিছু বই ছাপানো হবে। শিক্ষার্থীদের শূন্যতাকে অনুভব করেই কাজে হাত দিচ্ছি।
মানসুর আলম শিকদার : বিমা খাত একটি সাগর, সমুদ্র। আমি ৩০ বছর ধরে বুঝতেছি। এখনো এখানে ঘুরপাক খাই। কেউ এখানে এসে দুই বছরে সব জানতে পারবে, কীভাবে সম্ভব?
মানসুর আলম শিকদার : প্রথম সমস্যা অজ্ঞতা, সমসাময়িক সুচিন্তার অভাব। দ্বিতীয়, আগে ২৫ হাজার টাকার ছিল এক টাকা প্রিমিয়াম। এখন ৫ হাজার টাকার প্রিমিয়াম দিতে হচ্ছে ৪০ টাকা, সঙ্গে আরো অন্যান্য খরচ আছে। নতুন করে বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা পলিসির কাঠামোতেও অনেক সমস্যা রয়েছে।
দুর্ঘটনায় বিমার ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০ বছর আগে ছিল ২০ হাজার টাকা। এখনো সেই আইন আছে- কেউ গ্রহণ করবে? ২০ বছর আগে ঢাকার শাহজাহানপুরে ৩ শতক জমির দাম ছিল ২০ হাজার, এখন সেই জমির মূল্য ৩ কোটি টাকা। বিমার ক্ষতিপূরণ কি টিকবে? লোকে আগ্রহী হবে?
বিমা কোম্পানিতে গ্রাহক একটি পলিসি করলেন, কিন্তু কোনো একটি কিস্তি গ্রাহক দেয়নি, অথবা দু-এক কিস্তি দেয়ার পরে গ্রাহক পলিসি বন্ধ করে দেন। তাহলেই বিপদ। বিমার কোনো টাকাই গ্রাহক আর ফেরত পাবেন না। দেশের কোন আইনে আছে ফেরত পাবেন না। অথচ অনেক কোম্পানির প্রতিনিধিরা এই অপকর্ম করছেন। তারা বলছেন, আপনার টাকা তামাদি হয়েছে। আপনি আর টাকা ফেরত পাবেন না। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বা অনেক বিমা কোম্পানির কাছে এমন অজস্র অভিযোগ রয়েছে। সব কিস্তি পরিশোধের পরেও বিমা কোম্পানি গ্রাহকের নির্দিষ্ট টাকা পরিশোধ করছে না। এভাবে কোনো বিমা কোম্পানি চলতে পারে না! যে কারণে বলছিÑ বিমা ভূতে চালায়।
মানসুর আলম শিকদার : বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান এখানে কী করবেন? তিনি ৩ বছরে কি বদলাতে পারবেন? তার চেয়ে আরো বড় কথা সমুদ্রের কতটুকু তিনি ৩ বছরে জানবেন। মূল সমস্যা হলো আরো বড় জায়গায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ে যদি পরিকল্পনায় ভুল করে তার প্রতিফলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, পড়ছেও তাই। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এসেই কি তিনি এক দিনে রোগ চিনবেন? আর কী-ইবা ওষুধ দেবেন। কাজেই রোগ আছে কিন্তু ওষুধ নেই। সেজন্য বলি, বিমা কোম্পানি ভূতে চালায়।
মানসুর আলম শিকদার : আমি যেতে চাই, তবে নির্বাহী ক্ষমতা দিতে হবে। প্রথমেই মানিলন্ডারিং বিষয়ে ব্যবস্থা নেব। কোন কোম্পানি অপরাধ করেছে, তাৎক্ষণিক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রয়োজনে তার লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। দেশের বিমা খাতের চেহারা বদলে যাবে।
মানসুর আলম শিকদার : আপনাকেও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।