সকল মেনু

ঋণের দায়ে পলাতক অ্যাপোলো ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

সিনিয়র রিপোর্টার: অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স লিমিটেডের ঢেউটিন উৎপাদন প্রায় দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। ৪০১ কোটি টাকার অনুমোদিত কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ১১০০ কোটি টাকা। চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদসহ চার সদস্যের মৃত্যুর পরে কোম্পানিটির আর্থিক সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রফিকুল পলাতক রয়েছেন। ‘রানী মার্কা ঢেউটিন’ ব্র্যান্ডের এ কোম্পানির পর্ষদকে না জানিয়ে ব্যস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিদেশে অবস্থান করছেন বলেও দাবি করেছেন ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শোয়েব। যার কারণে অর্থ সঙ্কটের পাশাপাশি কোম্পানিটি নতুন করে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কোম্পানির তথ্যমতে, ৪০১ কোটি টাকার অনুমোদিত কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ১১০০ কোটি টাকা। ডুবন্ত কোম্পানিকে টেনে তুলতে এমডি মোহাম্মদ রফিকুল ও সাবেক সিইও রাজিব হোসেনের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে পরিচালনা পর্ষদ। একইসঙ্গে কোম্পানিতে নতুন করে বিনিয়োগকারী আনাসহ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আগামী ৬ মাস সময় চেয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের(বিএসইসি) কাছে আবেদন করেছে কর্তৃপক্ষ।

গত ১৭ আগস্ট এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কাছে পাঠানো হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে কঠিন সময় পার করছে অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স। কারণ, এর আগে কিছু কর্মচারী কোম্পানির স্বার্থের বাইরে গিয়ে নিজের স্বার্থে কাজ করেছে। কোম্পানির তহবিল থেকে ইচ্ছেমতো ব্যয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর ফলে কোম্পানির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং আর্থিক সংকট আরও প্রকট হয়েছে। অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্সের ভাইস-চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শোয়েব বিএসইসির কাছে ৬ মাস সময় চেয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি লিস্টিং ফি এবং জরিমানা মওকুফসহ একটি কৌশলগত বিনিয়োগকারী আনার মাধ্যমে কোম্পানি পুনর্গঠন করতে চান।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ৬ মাস সময়ের মধ্যে কোম্পানির অসুবিধা কমে আসবে। কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের আনা হবে। সব মিলিয়ে কোম্পানি পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে আরও ছয় মাস সময় দেওয়া হলে ভালো হবে। এছাড়া যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি একটি পরিচালনযোগ্য পরিস্থিতিতে না আসে ততক্ষণ সারচার্জ, জরিমানা, তালিকা ফি মওকুফ করার দাবি জানানো হয়েছে। কারণ, এক সময়ের লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি এখন কঠিন সময় পার করছে। একইসঙ্গে বড় আর্থিক সংকটে ভারাক্রান্ত।

ডিএসই সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বাজার থেকে ২১৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করে কোম্পানিটি। তালিকাভুক্তির পর ফার্মটি প্রথম তিন বছর উচ্চ মুনাফা দেখিয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে প্রাক-আইপিও শেয়ারগুলো বাজারে বিক্রির যোগ্য হওয়ার পরে ব্যবসায় পতন শুরু হয়।

২০১৯ সাল থেকে ফার্মের ব্যবসায়িক পারফরম্যান্স সম্পর্কে অন্ধকারে ছিলেন শেয়ারহোল্ডাররা। কারণ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কোম্পানিটি ৯২ কোটি টাকার নিট লোকসান প্রকাশের পরে আর কোনও তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শোয়েব কমিশনের কাছে অভিযোগ করেন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

এছাড়া সঠিক ব্যবস্থাপনা দলের অভাব এবং বোর্ড সদস্যদের অনুপস্থিতির কারণে কোম্পানিটি গত দুই বছর ধরে উৎপাদনের বাইরে রয়েছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে বিনিয়োগকারীদের অন্ধকারে রাখে একসময়ের প্রভাবশালী কোম্পানিটি। কারণ, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইট বা নিজস্ব ওয়েবসাইটে কোনও আর্থিক তথ্য উপলব্ধ নেই।

একইসঙ্গে মহামারি চলাকালীন সময়ে চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ, প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনসার আলী, পরিচালক ও ডিএমডি আবদুর রহমানসহ চার প্রধান সদস্যের মৃত্যু হয়। এছাড়া চলতি ২০২৩ সালের ১৫ মে কোম্পানি সচিব এসকে আবুল হাসানের মৃত্যুতে তার পদ শূন্য হয়।

কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, উদ্যোক্তাদের মধ্যে দ্বীন মোহাম্মদ, আনসার আলী এবং আবদুর রহমান কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের যথাক্রমে ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ শেয়ারের মালিক।

বিএসইসিতে পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়, অতীতের অনেক কর্মচারী কোম্পানির তহবিলের ব্যাপক অব্যবস্থাপনা করেছেন এবং স্বার্থবিরোধী কাজ করেছেন। সর্বশেষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিক বোর্ডকে না জানিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, যা কোম্পানির আরও ক্ষতির কারণ হয় এবং আর্থিক সংকটকে প্রসারিত করে। প্রসপেক্টাস অনুসারে কোম্পানির ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ শেয়ার ছিল তার।

এ বিষয়ে ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, মো. রফিক এবং সাবেক প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) রাজিব হোসেনের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছি। একইসঙ্গে কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে মিলে কোম্পানি পরিচালনার চেষ্টা করছি। কোম্পানির ঋণ ১১০০ কোটি টাকা হলেও সম্পদ রয়েছে ১৫০০ কোটি টাকার।

২০১৩ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয় অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স লিমিটেড। তখন কোম্পানিটির মোট সম্পদ ছিল ৭৩৩ কোটি টাকা এবং দায় ছিল ৩৯৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে ১৩৫ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি এবং ৩৪ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে।

প্রসপেক্টাস অনুসারে, এখন কোম্পানির দায় দাঁড়িয়েছে ১১০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৯০০ কোটি টাকা সুদসহ জরিমানা এবং অন্যান্য দায় রয়েছে ২০০ কোটি টাকা। চিঠিতে আরও দাবি করা হয়, সবকিছু মিলিয়ে কোম্পানির বর্তমান মূল্য হবে প্রায় ১৪০০-১৫০০ কোটি টাকা।

চলমান আর্থিক সংকটের মধ্যে কোম্পানির জন্য কৌশলগত বিনিয়োগকারী না পেলে সব আর্থিক বাধ্যবাধকতা মেটানো সম্ভব নয় বলে দাবি করেছে বর্তমান পর্ষদ। এ বিষয়ে মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, আমরা কৌশলগত অংশীদার বা বিনিয়োগকারী খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। যারা কোম্পানি পুনর্গঠন করতে আমাদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে।

তিনি বলেন, অ্যাপোলো ইস্পাতে বিনিয়োগে আগ্রহী এমন কিছু বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আমরা আলোচনার প্রক্রিয়ায় আছি। একজন কৌশলগত বিনিয়োগকারীর সন্ধানসহ আর্থিক এবং কর্পোরেট পুনর্গঠন সম্পূর্ণ করতে ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

এদিকে অ্যাপোলো ইস্পাত যখন পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের জন্য জনসাধারণের কাছে আবেদন করে তখন সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এ এম এ মুহিত ‘না’ করেছিলেন। তিনি তৎকালীন বিএসইসি চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনকে কোম্পানিটিকে মূলধন সংগ্রহ করতে না দেওয়ার জন্য বলেছিলেন। কারণ হিসেবে মুহিত বলেছিলেন, কোম্পানিটি ঋণ এবং কর উভয় ক্ষেত্রে অনিয়ম করেছে।
প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯০-এর দশকে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা আওয়ামী লীগ নেতা ও উদ্যোক্তা দ্বীন মোহাম্মদ। মোহাম্মদের বেশ কিছু অংশীদার এবং শীর্ষস্থানীয় ম্যানেজার বছরের পর বছর ধরে ফার্মের অর্থ আত্মসাতে নিয়োজিত ছিল।

গত চার বছর ধরে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ না দেওয়া, উৎপাদন বন্ধ এমনকি ঋণে জর্জরিত কোম্পানিটি। এখানেই শেষ নয়, গত চার বছর ধরে কোম্পানির অবস্থা কী- তা বিনিয়োগকারী তো দূরের কথা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও স্টক এক্সচেঞ্জকেও জানায়নি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ২২ এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অপরদিকে আইন ভাঙার কারণে কোম্পানির পরিচালক ইভানা ফাহমিদা মাহমুদ, রোকসানা বেগম, এম এ মাজেদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুলকে শাস্তির আওতায় এনেছে বিএসইসি। তাদের সবাইকে এক লাখ টাকা করে মোট ৪ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, কোম্পানির পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনেক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এক বছর ৯ মাসের আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেয়ার কারণে তিন পরিচালক ও এমডিকে চার লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত এক বছর এবং ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত মোট ৯ মাসের তিন প্রান্তিকের প্রতিবেদন জমা দেয়নি অ্যাপোলো ইস্পাত। কমিশন ও স্টক এক্সচেঞ্জে আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন কোম্পানি সচিব এসকে আবুল হাসান।

তিনি বলেন, করোনায় ম্যানেজমেন্ট ক্রাইসিস ও লোকবলের অভাব ছিল। এ কারণে আর্থিক প্রতিবেদন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়; কিন্তু কমিশনে জমা দেওয়া হয়নি। কারণ, আমাদের চেয়ারম্যান দীন মোহাম্মদ মারা যাওয়ায় তার স্বাক্ষর নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top