সকল মেনু

ফারইস্টের টাকায় ফ্লোরিডায় সাবেক চেয়ারম্যানের বিলাসবহুল বাড়ি

শাহীনুর ইসলাম: ব্যাংক খাতে একসময় ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি ছিল বেসিক ব্যাংক, তেমনি বিমা খাতে ছিল ফারইস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। চেয়ারম্যান হিসেবে পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালনকালে শেখ আবদুল হাই বেসিক ব্যাংককে ধ্বংসের কিনারে নিয়ে গেছেন, ফারইস্ট লাইফেও একই পরিস্থিতি। বিপুলসংখ্যক পলিসি হোল্ডারের বিমা পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও কোম্পানি দাবি পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে।

ফারইস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেন কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামসহ আটজন। তিনিসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে ১১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে গতকাল বৃহস্পতিবার মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ সংস্থাটির উপ-পরিচালক শারিকা ইসলাম বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) মামলাটি দায়ের করেন। সংস্থার উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম। বাড়ি কিনতে কোনো ঋণ নেয়া হয়নি, অর্থাৎ পুরো অর্থই একবারে পরিশোধ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বাড়িটির ঠিকানা ১১৫২২ মানাতি বে এলএন, ওয়েলিংটন, এফএল ৩৩৪৪৯।

২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাড়িটি কেনা হয়েছিল ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩২৭ মার্কিন ডলার দিয়ে। এ ছাড়া ছেলেমেয়ের নামে মো. নজরুল ইসলাম একই রাজ্যে গড়ে তুলেছেন তিনটি কোম্পানি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সেই নজরুল ইসলামকে শাহবাগ থানার পুলিশ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আটক করে কারাগারে পাঠিয়েছে।

আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪০৯ ও ১০৯ ধারা ও মানিলন্ডারিং আইনে এই মামলা করা হয়েছে। আসামিরা হলেন- ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম ও সাবেক পরিচালক তার স্ত্রী তাসলিমা ইসলাম, জমি বিক্রেতা ও স্ত্রীর ভাই সেলিম মাহমুদ, সাবেক কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হেমায়েত উল্যাহ, সাবেক ইভিপি ইঞ্জিনিয়ার আমির ইব্রাহিম, সার্ভে রিপোর্ট প্রনয়ণকারী টিপু সুলতান, ফুয়াদ আশফাকুর রহমান ও মোহাম্মদ আলম খান। আটক নজরুল ইসলামসহ ফারইস্টের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ খালেক ও তার ছেলে রুবাইয়াত খালেককে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

কীভাবে তা সম্ভব হলো, তার একটি চিত্র উঠে আসে ফারইস্ট লাইফের ওপর করা সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানির এক বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ২০২১ সালের এপ্রিলে সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানিকে ফারইস্ট লাইফের ওপর নিরীক্ষা করার দায়িত্ব দেয়। গত মে মাসে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আইডিআরএর কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফারইস্ট লাইফ থেকে ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। এর বাইরে অনিয়ম হয়েছে ৪৩২ কোটি টাকার। অর্থাৎ কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ও পলিসিহোল্ডাররা তাদের ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা হারিয়েছেন। নজরুল ইসলাম, এম এ খালেকসহ কোম্পানির সাবেক সব পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. হেমায়েত উল্লাহ এবং কোম্পানির কিছু শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাও এ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটান।

বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে জমি কেনা, বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ফারইস্টের মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিট (এমটিডিআর) বন্ধক রেখে পরিচালকদের ঋণ নেয়া এবং ক্ষতিকর বিনিয়োগ Ñমূলত এই তিন উপায়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। এমটিডিআর হচ্ছে একধরনের স্থায়ী আমানত।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৯নং ওয়ার্ডের রমনা থানার কাকরাইল মৌজায় বিভিন্ন মালিকের কাছ থেকে ৮ হাজার বর্গফুটের পুরাতন ভবনসহ ৩২ শতাংশ জমি কেনে। তার মধ্যে ২৮ শতাংশ জমি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামের শ্বশুর মো. মফিজুল ইসলাম ও স্ত্রীর বড় ভাই মো. সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে কেনা হয়।

নজরুল ইসলাম ও আসামিরা নীতিমালা ভঙ্গ করে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ভুয়া সার্ভে ফার্মের সহযোগিতায় ২৮ শতাংশ জমি প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের জন্য ক্রয় করেন। পরবর্তীতে নজরুল ইসলাম, তার স্ত্রী, তার শ্বশুর ও স্ত্রীর ভাইয়ের জমি বিক্রি করে ১১৫ কোটি টাকা নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে স্থানান্তর করে অর্থ আত্মসাৎ করেন।

জমি কেনায় বড় আত্মসাৎ

২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ফারইস্ট লাইফ ঢাকাসহ দেশের ১৪টি স্থানে জমি কেনে। এসব জমি কেনা হয় বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে। এর মধ্যে ৭টি জমি কেনা ও ভবন নির্মাণ এবং বালু ফেলার নামে ৬৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ির ৭৮৬ শতাংশ জমি ১৯৯ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে বলে হিসাবে দেখানো হয়েছে। বাস্তবে এ জমি কেনা হয়েছে ১৯ কোটি টাকায়। ১৯৯ কোটি টাকার মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে চেকে দেয়া হয়েছে ৬৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং, কেডিসি কনস্ট্রাকশন ও মাহবুবা অ্যাসোসিয়েটকে চেকে দেওয়া হয়েছে ৪০ কোটি টাকা এবং রেজিস্ট্রেশন খরচ বাবদ চেকে দেয়া হয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাকি টাকা দেয়া হয়েছে নগদে।

কোম্পানির ৭২ কাকরাইলের জমি কেনায় ১৬০ কোটি এবং গুলশান নর্থ অ্যাভিনিউয়ের জমি কেনায় ৮৯ কোটি, গুলশানের আরও ২ জমিতে ৮০ কোটি এবং বরিশালের আলেকান্দায় এক জমি কেনায় ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কাকরাইলের জমি কেনা হয়েছে নজরুল ইসলামের শ্বশুর মো. মফিজুল ইসলাম ও স্ত্রীর ভাই সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে। জমি বিক্রির পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাছলিমা ইসলামকে ১১৫ কোটি টাকা উপহার দেন মফিজুল ইসলাম ও সেলিম মাহমুদ। তাছলিমা ইসলাম আবার সেখান থেকে ৫০ কোটি টাকা উপহার দেন তার স্বামী নজরুল ইসলামকে।

তোপখানা রোডের জমি কেনা হয়েছে নজরুল ইসলামের বন্ধু নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের দুই সহোদর মো. সোহেল খান ও মো. আজাহার খানের কাছ থেকে। আর মিরপুর চটবাড়ির নিচু এলাকার জমি কেনা হয়েছে ২০ জন বিক্রেতার কাছ থেকে।

দলিলগুলোতে বলা হয়েছে, জমির মালিকদের টাকা দেয়া হয়েছে নগদে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বিমা আইন অনুযায়ী, ৫ হাজার টাকার বেশি হলেই লেনদেন করতে হয় ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে।

এফডিআর বন্ধক রেখে ঋণ

নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমটিডিআর বন্ধক রেখে ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ফারইস্ট লাইফের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের একাংশ। এর মধ্যে এম এ খালেক, প্রাইম প্রোপার্টি, প্রাইম ফাইন্যান্স, ম্যাকসন্স, মিজানুর রহমানের নামে বন্ধক রেখে ৫৪২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

বলা হয়েছে, ফারইস্টের এমটিডিআর বন্ধক রেখে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির নামে ১৬৪ কোটি, পিএফআই প্রোপার্টিজের নামে ১৬০ কোটি, ফারইস্ট প্রোপার্টিজের নামে ১৫১ কোটি, প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশনের নামে ৯২ কোটি, মিথিলা প্রোপার্টিজের নামে ৬৪ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজের নামে ৫৫ কোটি, মিথিলা টেক্সটাইলের নামে ৪৮ কোটি, কে এম খালেদের নামে ২১ কোটি, মোল্লা এন্টারপ্রাইজের নামে ২০ কোটি, আজাদ অটোমোবাইলসের নামে ৯ কোটি এবং কামাল উদ্দিনের নামে ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

ক্ষতিকর বিনিয়োগ ও অনিয়ম

নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ক্ষতিকর বিনিয়োগের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের ২৮৭ কোটি টাকার তহবিল আত্মসাৎ করে কোম্পানিটির সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা।

এর মধ্যে বাংলালায়ন কনভার্টেবল জিরো কুপন বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৪০ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৩২ কোটি, প্রাইম ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৪ কোটি, আল-ফারুক ব্যাগসে বিনিয়োগের মাধ্যমে ২ কোটি এবং কর্মকর্তাদের নামে ভুয়া ব্যাংক হিসাব দেখিয়ে ৮৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ ছাড়া তিন বছরে ৪৩২ কোটি টাকার পরিচালনাগত ত্রুটি ও অনিয়ম হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান হাসিনা শেখ বলেন, এ যেন বিমা খাতের বেসিক ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন না থাকলে কী হয়, তারই বড় উদাহরণ ফারইস্ট লাইফ। প্রতিষ্ঠানটির ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা লুটপাটের পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কারণ, একটি কোম্পানির এমন ঘটনা পুরো খাতের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকারক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top