সকল মেনু

সেই অ্যাননটেক্স গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংকের ৭০০ কোটি টাকা ঋণ

বিশেষ প্রতিনিধি: তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা ইসলামী ব্যাংক অ্যাননটেক্স গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানকে ৭০০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। অথচ গ্রুপটি জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া শীর্ষ পাঁচ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। শুধু তাই নয় অ্যাননটেক্স গ্রুপ গত ১৩ বছরে ঋণ পরিশোধ না করেও জনতা ব্যাংক থেকে অযৌক্তিক সুবিধা ভোগ করেছে।

গত ২৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির ১৯৯৭তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, সেদিনই অ্যাননটেক্সের সহযোগী প্রতিষ্ঠান শব মেহের স্পিনিং মিলসকে এই ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়।

২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত রপ্তানিমুখী পোশাক তৈরি প্রতিষ্ঠান অ্যাননটেক্স গত মাসে জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে একটি বড় সুবিধা পাওয়ার পর ইসলামী ব্যাংক থেকে এই ঋণ পাচ্ছে।

এর আগে, গত বছরের নভেম্বরে জনতা ব্যাংকের বোর্ড অ্যানটেক্সকে ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা সুদ মওকুফের সুবিধা দিয়েছিল। তবে শর্ত ছিল যে, চলতি বছরের ১৫ জুনের মধ্যে মূল ঋণ পরিশোধ করতে হবে। না হলে এই ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানো হবে।

২০২২ সালের শেষে জনতার ব্যাংকের কাছে অ্যাননটেক্সের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের ৩৩৪ শতাংশ। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের একক ঋণগ্রহীতার সর্বোচ্চ সীমার অতিক্রম।

অ্যাননটেক্সের ওয়েবসাইটে ব্রিটিশ ব্র্যান্ড টেসকো ও নিউ লুক এবং স্পেনের জারাকে তাদের ক্লায়েন্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে। একইসঙ্গে বার্ষিক টার্নওভার দেখানো হয়েছে ১৫০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু, তারা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে।

তারপরও তাদের ঋণকে খেলাপি করা হয়নি, বরং অ্যাননটেক্সকে জনতার ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে বছরের শেষ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন-২০২৩ অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান কোথাও ঋণ খেলাপি হলে নতুন করে ঋণ পেতে পারে না।

অ্যাননটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান ইউনুস (বাদল) জানান, জনতা ব্যাংকের কাছে শব মেহের স্পিনিং মিলসের ১০৫ কোটি টাকা ঋণ আছে, যা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বকেয়ার একটি অংশ।

এর আগে, ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ অনুযায়ী কোনো গ্রুপের কোনো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা পরিচালক খেলাপি হলে পুরো গ্রুপ নতুন করে ঋণ সুবিধা পাওয়ার অযোগ্য হয়ে যেত। কিন্তু, বহুল সমালোচিত ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন-২০২৩-এ এটি এমনভাবে সংশোধন করা হয়েছে, যেন শুধু খেলাপি ব্যক্তি নতুন ঋণ পেতে না পারেন, পুরো গ্রুপ নয়।

ইসলামী ব্যাংক নিজেই যখন অনেক সংকট মোকাবিলা করছে, তখন কেন এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মনিরুল মওলা বলেন, ঋণ অনুমোদন এখনো প্রক্রিয়াধীন, তাই আমি এখনই বিস্তারিত বলতে পারব না। তবে কোম্পানিটি ঋণ পাওয়ার পুরোপুরি যোগ্য।

কিন্তু, ইসলামী ব্যাংকের নথিতে দেখা গেছে- ইতোমধ্যে দিলকুশায় অবস্থিত তাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ করপোরেট শাখা গত ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত  শব মেহের স্পিনিং মিলসকে ১৪০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে।

এ বিষয়ে অ্যাননটেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইউনুস গত শনিবার বলেন, ইসলামী ব্যাংক ৭০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে কিনা তা আমি নিশ্চিত নই।

তিনি আরও বলেন, ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শব মেহের স্পিনিং মিলসের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে এই ঋণ কাজ করবে। জনতা ব্যাংক অ্যাননটেক্সের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ স্থগিত করার পর এই ঋণের জন্য আবেদন করা হয়েছিল।

জনতা ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করতে এনওসি (অনাপত্তিপত্র) দেওয়ায় আমরা দীর্ঘদিন ধরে শব মেহের স্পিনিং মিলসের জন্য ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকিং করছি, বলেন তিনি।

যাইহোক, ব্যাংকিং খাতের জন্য বিতর্কিত এই ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ঋণ সুবিধা দেওয়ায় তারল্য সংকটে জর্জরিত ইসলামী ব্যাংকের সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, এটি ব্যাংকের যথাযথ সতর্কতার অভাব। যখন কোনো ব্যাংক ঋণ অনুমোদনের সময় যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে না, তখন বলা যায় সেই ব্যাংকের সুশাসন খুবই দুর্বল।

তিনি আরও বলেন, কোনো ব্যাংক কোনোভাবেই একটি খেলাপি ব্যবসায়ী গ্রুপকে ঋণ দিতে পারে না।

মেঘনা ব্যাংক ও এনসিসি ব্যাংকের এমডি ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, এ ধরনের ঘটনা পুরো ব্যাংক খাতের জন্য অশনি সংকেত।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো- ঋণ বিতরণে ব্যাংকিং বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠার পর গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ইসলামী ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিযুক্ত করা পর্যবেক্ষক থাকাকালে এই ঘটনা ঘটলো।

কিন্তু, অ্যাননটেক্সকে ঋণ অনুমোদনের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান পর্যবেক্ষক সারওয়ার হোসেন।

এদিকে ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সংকট এতটাই প্রকট যে, তারা চলতি বছরের প্রথমার্ধের বেশিরভাগ সময় নগদ ও তারল্যের ন্যূনতম সীমা বজায় রাখতে পারেনি। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৬২ কোটি টাকা জরিমানা করে। কিন্তু, তারা সেই টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয় এবং ব্যাংকটিকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।

শুধু তাই নয়, গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তারল্য সহায়তা নিচ্ছে ইসলামী ব্যাংক। ২০২২ সালের শেষ কর্মদিবস ২৯ ডিসেম্বর তাৎক্ষণিক তারল্য চাহিদা মেটাতে বিশেষ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা নিয়েছিল বেসরকারি ব্যাংকটি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top