সকল মেনু

আন্তর্জাতিক মানের পুঁজিবাজার চাই

ঢাকা স্টক এক্সচঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ১৭ সেপ্টেম্বর যোগ দিয়েছেন ড. এটিএম তারিকুজ্জামান। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পরে তিনি এক্সচেঞ্জটির পঞ্চম ব্যবস্থাপনা পরিচালক। স্টক এক্সচেঞ্জটিতে যোগ দেয়ার আগে তিনি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ছিলেন।

ড. তারিকুজ্জামানের ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজার নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন তিনি। সম্প্রতি দেশের পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা ও ডিএসইতে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার নানা দিক নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত

  • বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের পথচলা ছয় দশক পেরিয়েছে। সুদীর্ঘ এ সময়ে প্রত্যাশা অনুসারে পরিণত হতে পারেনি পুঁজিবাজার। বিশেষ করে আমাদের অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি সেটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুঁজিবাজারের প্রবৃদ্ধি হয়নি। এক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা কিংবা কারণগুলো কী?

পুঁজিবাজার নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা তো অনেক। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কী চাই? আমরা সবাই একটি স্বচ্ছ ও দক্ষ পুঁজিবাজার চাই। আর এর পুরোটাই সুশাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সুশাসন শুধু বলেকয়ে করা যায় না। সুশাসনের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হয়। সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয় তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে মানুষকে বোঝাতে হবে কোনটি ঠিক আর কোনটি ভুল। সুশাসনের সুবিধাগুলো কী সেটি আমাদের বুঝতে হবে। সুশাসনে উন্নতি হলে যে সব পক্ষই সুবিধা পায় এ বিষয়ে জানাতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের জানার ঘাটতি আছে। আর্থিক সাক্ষরতার দিক দিয়ে উন্নত দেশ তো বটেই পার্শ্ববর্তী দেশ থেকেও আমরা পিছিয়ে আছি। এখানে ডিএসইর ভূমিকা আছে।

আমাদের বর্তমানে বিনিয়োগ শিক্ষাসংক্রান্ত বেশকিছু কর্মসূচি আছে। এটিকে আরো বিস্তৃত করতে চাই। তালিকাভুক্ত কোম্পানি, বাজার মধ্যস্থতাকারী ও বিনিয়োগকারী সবাইকে এর আওতায় নিয়ে আসতে চাই। আমাদের দুই ধরনের ভূমিকা আছে। একটি হলো কোচ এবং আরেকটি রেফারির ভূমিকা। কোচ হিসেবে আমরা সবাইকে জানিয়ে দেব যে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না।

অন্যদিকে রেফারি হিসেবে কোনো ধরনের ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হলে আমরা সেক্ষেত্রে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেব। সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এর সঙ্গে সংগতি রেখে আমরাও স্মার্ট পুঁজিবাজার গড়তে চাই। এজন্য তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে হবে, যাতে সুশাসন পরিস্থিতির উন্নতি হয় এবং সময়মতো বিনিয়োগকারীদের তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।

  • তথ্যপ্রযুক্তিগত সক্ষমতায় পিছিয়ে থাকার কারণে কভিডের সময়ে ৬৬ দিন দেশের পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ ছিল। উন্নত দেশগুলোয় পুঁজিবাজারের লেনদেন মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। দেশের পুঁজিবাজারে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে আপনাদের পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাই।

তথ্যপ্রযুক্তিগত অবকাঠামো ডিএসইর মেরুদণ্ড। এটিকে উন্নত করতেই হবে, অত্যাধুনিক করতেই হবে। হাই ফ্রিকোয়েন্সির ট্রেডিং করতে হবে আমাদের। এজন্য হাই ফ্রিকোয়েন্সির প্রযুক্তিরও দরকার হবে। আরো বেশকিছু প্রযুক্তি আমাদের প্রয়োজন হবে। যেমন অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ওএমএস), ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদি। এর সঙ্গে সিডিবিএলের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধন করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি সমন্বিত প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রয়োজন পড়বে।

তাহলে আমাদের বাজার আরো বড় ও স্বচ্ছ হবে এবং বাজারে লেনদেন ও তারল্য প্রবাহ বাড়বে। এতে সুশাসনেরও উন্নতি হবে। ব্রোকারেজ হাউজের যে ব্যাক অফিস সফটওয়্যার আছে সেটিকেও অঙ্গীভূত করতে হবে। ডাটা রিকভারি সাইট (ডিআরএস) স্থাপন, সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোও আমার বিবেচনায় রয়েছে।

  • ইকুইটি-নির্ভর হওয়ার কারণে আমাদের পুঁজিবাজারে ঝুঁকিও তুলনামূলক বেশি। তাছাড়া ইকুইটির বাইরে বিকল্প পণ্য খুব বেশি না থাকায় সব শ্রেণীর বিনিয়োগকারীদের বাজারের প্রতি আকৃষ্টও করা যাচ্ছে না। পুঁজিবাজারে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি?

পণ্যে বৈচিত্র্য আনা আমাদের অন্যতম একটি এজেন্ডা। পুঁজিবাজারে পণ্য বাড়ছে না কেন সেটি যদি আমরা দেখি তাহলে যেতে হবে ইস্যুয়ারের কাছে। তাদের পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের জন্য বলতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে ব্যবসার প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান পুঁজিবাজারের মাধ্যমেও করা সম্ভব। অনেকে হয়তো জানেই না কীভাবে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ তুলতে হয়। এ জায়গাটায় আমাদের জানার কিছুটা ঘাটতি আছে। অনেকে বলতে পারে যে পুঁজিবাজারে এলে অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়, এটি ঠিক। কিন্তু এতে দীর্ঘমেয়াদে সে প্রতিষ্ঠানই উপকৃত হবে সেটি ইস্যুয়ারকে বোঝাতে হবে।

  • দেশে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি ব্যবসা করলেও তাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। পুঁজিবাজারে বহুজাতিক কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়াতে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

অবশ্যই আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। পুঁজিবাজারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কেন আসছে না সেটি নিয়ে কোনো স্টাডি নেই। তাদের তালিকাভুক্ত করতে হলে আগে জানতে হবে, কেন তারা পুঁজিবাজারে আসছে না। কারণ জানতে পারলে আমরা সেটি সমাধানের জন্য কাজ করতে পারব। আমার মনে হয় এখনই সঠিক সময় বিষয়টি তাদের জিজ্ঞেস করা যে কেন তারা পুঁজিবাজারে আসছে না। যদি এক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকে তাহলে সেটি সবাই মিলে সমাধান করার উদ্যোগ নিতে হবে।

  • ভারতের পুঁজিবাজারে আগামী বছর থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমাদের পুঁজিবাজারে লেনদেন নিষ্পত্তির সময় কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হবে কি?

বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় আছে। আমি যখন কমিশনে ছিলাম সে সময় বিএসইসির চেয়ারম্যানও আমাকে বলেছিলেন বিষয়টি দেখতে। এটি আমাদের স্টাডির মধ্যে আছে। আমাদের এখানে এটি চালু করা সম্ভব কিনা সেটি দেখছি। সম্ভব হলে আমরা চাই লেনদেন নিষ্পত্তির সময় যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে। কারণ যত দ্রুত লেনদেন নিষ্পত্তি হবে তত তাড়াতাড়ি বিনিয়োগকারীরা লেনদেন করতে পারবে এবং এতে বাজারে তারল্যও বাড়বে।

  • আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি যে বেশকিছু ব্রোকারেজ হাউজ গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করেছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় কী?

সুশাসন। বাজারে সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে হবে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের কারসাজি হতে পারে যেমন- ইনসাইডার ট্রেডিং, গুজবের মাধ্যমে প্রভাবিত করা ইত্যাদি। মার্কেট সার্ভিলেন্স ও বিনিয়োগকারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এগুলো প্রতিরোধ করা যেতে পারে। বাজার মধ্যস্থতাকারী যারা আছে তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো আরো বেশি যথাযথ হতে হবে।

কারণ তাদের কাছে গ্রাহকের সম্পদ যেমন শেয়ার ও অর্থ থাকে। ফলে তাদের কার্যক্রমে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীদের অর্থ তছরুপ না হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের কাছে সময়মতো তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঠিক তথ্য পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ ও সত্য তথ্য দিচ্ছে কিনা সেটি দেখতে হবে।

  • আপনি বিনিয়োগকারীদের তথ্যপ্রাপ্তির কথা বলছিলেন। বর্তমানে কোম্পানিগুলো সিদ্ধান্ত হওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে সে তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে পাঠাচ্ছে। যদিও বিনিয়োগকারীরা লেনদেন শুরুর সময় স্টক এক্সচেঞ্জে সে তথ্য পাচ্ছেন। এ তথ্য বিতরণ প্রক্রিয়ায় সময় কমিয়ে আনা তো খুব কঠিন কিছু নয়। এমনকি তাৎক্ষণিকভাবেই এ তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে দেয়া সম্ভব?

এটা অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু এজন্য তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিটি সমন্বিত হবে হবে। বর্তমানে কোম্পানিগুলো আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্যগুলো আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। আমাদের কর্মকর্তারা ম্যানুয়ালি সেগুলো স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে আপলোড করছেন। এর মানে হচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জের প্লাটফর্মে কিন্তু সরাসরি কোম্পানিগুলো তথ্য দিচ্ছে না। আমরা চাইছি কোম্পানিগুলোই স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে যথাযথ ও সঠিক তথ্য সময়মতো প্রকাশ করুক। এক্ষেত্রে ৩০ মিনিট কেন, সিদ্ধান্ত নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তথ্য দেয়া সম্ভব। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি।

  • ডিএসইকে নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাই

আমি কী করতে চাই সেগুলোর বেশকিছু এর মধ্যেই বলেছি। আমি কিছু বিষয়কে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখছি। যেমন অবকাঠামোগত পরিবর্তন এবং এমন একটি জায়গায় নিতে চাই যাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থার উন্নতি হয়। সুশাসনে উন্নতির বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছি। হাই ফ্রিকোয়েন্সি ট্রেডিংয়ের কথা তো বলেছিই। বাজার যখন এ ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবে তখন অনেক কোম্পানিই এখানে আসতে আগ্রহী হবে বলে আমার ধারণা। কিছু আইনগত দিক আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে।

আমরা একটি আন্তর্জাতিক মানের পুঁজিবাজার দেখতে চাই। দেশের অর্থনীতি যখন এগিয়ে চলছে, পুঁজিবাজারও এগিয়ে যাবে এটা আমার বিশ্বাস। এটি কখনই পিছিয়ে থাকতে পারে না এবং থাকবে না। একটি উন্নত মানের মূলধন বাজার আমাদের এখানে সৃষ্টি হবে বলে আমি মনে করি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top