সকল মেনু

মুনাফা ও বিনিয়োগের নেই নিশ্চয়তা, বাড়ছে হতাশা

শাহীনুর ইসলাম: পুঁজিবাজারে নেই বিনিয়োগের নিশ্চয়তা এবং নেই মুনাফা। অন্যদিকে বইছে হতাশার লু হাওয়া। একইসঙ্গে দীর্ঘ অর্থনৈতিক সংকট, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা, ক্রমবর্ধমান সুদ ও ডলারের বিপরীতে কমছে টাকার মান।

যে কারণে পুঁজিবাজারে সূচকও ক্রমাগত পড়ছে। সুরাহা না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ক্রমাগত ছাড়ছেন পুঁজিবাজার। তাদের প্রতিদিন কমছে বিনিয়োগ, বাড়ছে হতাশা। যে কারণে ব্যাংকের সঞ্চয় ভাঙ্গিয়েও চলছেন অনেকে।

এদিকে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) গতকাল ঢালাও দরপতন হয়েছে। রোববার ক্রেতা সংকটে পড়ে সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমে। ডিএসইতে দর কমার পাশাপাশি সবকটি মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে। সেই সঙ্গে কমেছে লেনদেনের পরিমাণও।

রোববার ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ৮৫ শতাংশ কমে ৫৪৩১ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। যা ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল ছিল ৪ হাজার ৪৩৫ পয়েন্টে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) রোববার সবকটি খাতের প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দামে ঢালাও পতন হয়েছে। বাজারটিতে ৮৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। এতে ডিএসই’র প্রধান মূল্যসূচক দেড় শতাংশের ওপরে কমেছে। সেই সঙ্গে লেনদেন কমে ৪০৯ কোটি টাকার ঘরে চলে এসেছে।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) ঢালাও দরপতন হয়েছে। ফলে বাজারটিতেও সবকটি মূল্যসূচকের বড় পতন হয়। সেই সঙ্গে কমেছে লেনদেনের পরিমাণ। এর মাধ্যমে টানা ছয় কার্যদিবস পতনের মধ্যে থাকলো শেয়ারবাজার। এর আগে গত সপ্তাহে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসেই শেয়ারবাজারে দরপতন হয়। এতে এক সপ্তাহে ডিএসই’র বাজার মূলধন ৫ হাজার ২০২ কোটি টাকা কমে যায়। আর প্রধান মূল্যসূচক কমে ১৪৩ পয়েন্ট।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুসারে, গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা এক বছর আগের তুলনায় চার শতাংশেরও বেশি কমে ১৭ লাখ ৯০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। এক বছর আগে, বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৭১ হাজার। এটি ২০২২ সালের মে মাসে ছিল ২০ লাখ ৮০ হাজার। এর আগের বছরে একই মাসে ছিল ২৬ দশমিক ৬১ হাজার।

যদিও বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রকৃত বিনিয়োগকারীর সংখ্যা জানা যায়না। তবে, ১৭ কোটি মানুষের দেশে সংখ্যাটি এখনো নগণ্য। পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন সুশাসনের অভাব, ভালো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম, ব্যাংকিং খাতে দ্রুত সুদের হার বাড়ানো ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে এই পতন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রায় তিন দশক ধরে পুঁজিবাজারে থাকা একজন বাজার বিশ্লেষক গত সপ্তাহে জানান, পরিস্থিতির আরও খারাপ হতে পারে এমন আশঙ্কায় তিনি বেশিরভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। তার এমন উদ্বেগের পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়াতে দীর্ঘদিন ধরেই হিমশিম খাচ্ছে অর্থনীতি।

২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। গত দুই বছরে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৩৫ শতাংশ। আমদানি হয়েছে ব্যয়বহুল। টাকার দাম আরও কমলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আরও শেয়ার বিক্রি করবেন বলে জানান এই বিনিয়োগকারী।

দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে মাত্র ২২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৪৭টি প্রতিষ্ঠানের। আর ১৯টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

ফলে ডিএসই’র প্রধান মূল্যসূচক ডিএসই-এক্স ৮৬ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৪৩১ পয়েন্টে নেমেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ২০ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ১৯১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর বাছাই করা ভালো ৩০টি কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ২৫ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৯৪৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

সবকটি মূল্যসূচক কমার পাশাপাশি ডিএসইতে ২৩ কার্যদিবসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৪০৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৬৭৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। সে হিসাবে লেনদেন কমেছে ২৬৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর আগে গত ১৫ এপ্রিল, এরচেয়েও কম ৩৬৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকার লেনদেন হয়।

টাকার অঙ্কে রোববার সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে বিচ হ্যাচারির শেয়ার। কোম্পানিটির ১৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ই-জেনারেশনের ১৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। ১৪ কোটি ৪ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে আইসিবি এএমসিএল সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড।

এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- ওরিয়ন ইনফিউশন, ওরিয়ন ফার্মা, ইউনিলিভার কনজুমার কেয়ার, লাভেলো আইসক্রিম, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সি পার্ল বিচ রিসোর্ট এবং রিলায়েন্স ওয়ান দ্য ফার্স্ট স্কিম অব রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স মিউচুয়াল ফান্ড।

অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ২৬৯ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ২২৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৫টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৮৬টির এবং ১২টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। লেনদেন হয়েছে ৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৫৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

দেশের বিনিয়োগকারীরা এমন সময়ে শেয়ারের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন যখন অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজার চাঙা হচ্ছে। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ৩০টি বড় প্রতিষ্ঠানের সূচক গত শুক্রবার প্রথমবারের মতো ৪০ হাজার পয়েন্ট হয়। গত মার্চে সংকটে থাকা অর্থনীতির মধ্যে জার্মানির বেঞ্চমার্ক ব্লু-চিপ স্টক ইনডেক্স প্রথমবারের মতো ১৮ হাজার পয়েন্টে পৌঁছায়।

বাহ্যিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিফটি ৫০ ও ভারতের বিএসই সেনসেক্স রেকর্ড করেছে। ২০২৩ সালকে ২০১৭ সালের পর দ্বিতীয় সেরা বছর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। গত সোমবার পাকিস্তানের বেঞ্চমার্ক সূচক ৭১ হাজার ৪৭৪ পয়েন্টের রেকর্ড উচ্চতায় লেনদেন করে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে এই বাজার ৭৪ শতাংশ বেড়েছে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও আইডিএলসি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বলেন, ভালো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করলে সাধারণত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির শিকার হন না। যদিও বেশিরভাগ ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে তারা ভবিষ্যতে আরও বেশি মুনাফা দিতে পারে। তাই বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সুদের হার বাড়ানোয় তা পুঁজিবাজারে প্রভাব ফেলেছে।

মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল (স্মার্ট) প্রবর্তন ও ঋণের নয় শতাংশ সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়ার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে গত ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে স্মার্ট ব্যবস্থা বাতিল করে। এটি বিলুপ্ত হওয়ার আগেও ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত তিন বছর ধরে চলা ঊর্ধ্বসীমার তুলনায় এটি অনেক বেশি। ট্রেজারি বিলের সুদের হার রেকর্ড ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। মানুষ বেশি মুনাফা পেতে ব্যাংকে টাকা রাখছেন। যদিও ট্রেজারি বন্ড থেকে প্রচুর মুনাফা আসছে।

মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন আরও বলেন, বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পুঁজিবাজারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কিন্তু, বাস্তবে এসব কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাজারে কেনার মতো শেয়ারের সংখ্যা অনেক থাকা উচিত। গ্রামীণফোনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে পারে। তারা গত এক দশক পুঁজিবাজারে আসেনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top