সকল মেনু

বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছে না জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য

ডেস্ক রিপোর্ট: বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমছে। গত মাসেও বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি গড় মূল্য ছিল ৮১ ডলার ৪০ সেন্ট। আর আন্তর্জাতিক বাজারে গতকাল মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম ছিল ৭৬ ডলারের নিচে। মূল্যে পতন অব্যাহত রয়েছে অন্যান্য বাজার আদর্শেও। দেশে জ্বালানি তেলের ‘স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ’ পদ্ধতি চালু রয়েছে গত মার্চ থেকে।

জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্টদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে এ মূল্য নির্ধারণ হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমতির দিকে থাকলেও চলতি মাসে জ্বালানি বিভাগ ডিজেল-কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম বাড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয়ের এ পদ্ধতি ঠিকমতো বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অতিমাত্রায় মুনাফার প্রবণতাকে দায়ী করছেন জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞরা। আর জ্বালানি তেলের এ উচ্চ মূল্যকেই দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন তারা।

তাদের ভাষ্য, এখানে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। অথচ বিপিসির মুনাফার অর্থ সমন্বয়ের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে ভোক্তার ওপর খরচের বোঝা বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতিও আরো বেড়ে যাচ্ছে।

বিপিসির হিসাব অনুযায়ী, জ্বালানি তেল বিক্রি করে গত নয় বছরে ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে সংস্থাটি। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত দীর্ঘ সময় মুনাফায় ছিল সংস্থাটি। এর মধ্যে শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা লোকসান দেয় বিপিসি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও বিপিসির নিট মুনাফা হতে পারে ৩ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। যদিও শুরুতে বিপিসি ১০ হাজার ১৯ কোটি টাকা নিট লোকসানের প্রাক্কলন করেছিল। আর গত অর্থবছরে সংস্থাটির নিট মুনাফা হয়েছিল ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরে যাবতীয় পরিচালন ও আর্থিক ব্যয় বাদ দিয়ে বিপিসি কর-পূর্ববর্তী মোট মুনাফা করেছে ৬ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। আর কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এ সময় সরকারি কোষাগারে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, লভ্যাংশ, আয়করসহ বিভিন্ন খাতে মোট ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছে বিপিসি।

দেশের বাজারে প্রতি বছর বিপিসির জ্বালানি তেল বিক্রি হয় ৭২ থেকে ৭৫ লাখ টন, যার বেশির ভাগই ডিজেল। সিংহভাগ ডিজেল ব্যবহার হয় পরিবহন খাতে। বাকিটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও অন্যান্য খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যস্ফীতির হিট ম্যাপের তথ্য অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতিতে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মধ্যে জ্বালানি খাতের প্রভাব অনেক বেশি। এর মধ্যে আবার জ্বালানির দাম বাড়লে পরিবহন, খাদ্য ও সেবার ব্যয়ভারও বেড়ে যায়।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি গড় মূল্য ছিল ৮১ ডলার ৪০ সেন্ট। এর আগে এপ্রিলে তা ছিল ৮৮ ডলার। আর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত গড় মূল্য ছিল ৮০ ডলার ৬০ সেন্ট। ২০২৩ সালে গোটা বছরজুড়ে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের গড় মূল্য ছিল ৮০ ডলার ৮০ সেন্ট। এর আগে ২০২২ সালে ছিল ৯৭ ডলার ১০ সেন্ট।

বিশ্ববাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের অংশ হিসেবে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করে সরকার। এরই অংশ হিসেবে চলতি বছরের ৭ মার্চ থেকে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় শুরু হয়। মার্চ থেকে এ পর্যন্ত চার দফা মূল্য সমন্বয় করেছে সরকার। এতে দেশের বাজারে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম দুই দফা কমেছে। বেড়েছেও দুই দফায়।

৩১ মে জারি করা জ্বালানি বিভাগের এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, চলতি মাসের জন্য ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১০৭ টাকা ৭৫ পয়সা, পেট্রল ১২৭ টাকা এবং অকটেনের দাম লিটারপ্রতি ১৩১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সময় দাম ডিজেল-কেরোসিনে লিটারপ্রতি ৭৫ পয়সা এবং পেট্রল ও অকটেনে লিটারপ্রতি আড়াই টাকা বাড়িয়েছে সরকার। এর আগে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকির চাপ এড়াতে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট গড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। সেই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অকটেনের দাম ৮৯ থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা আর পেট্রলের দাম ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করা হয়। এরপর ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২৩ দিনের মাথায় সব জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা করে কমানো হয়।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের যে কথা বলা হচ্ছে সেটি আদতে সমন্বয় হচ্ছে না। সমন্বয় বলতে মূলত বিপিসির ৫ শতাংশ মুনাফা রেখে ভোক্তা পর্যায়ে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্যটি সরবরাহ করার কথা। কিন্তু এখানে সরকার তথা বিপিসি সেটার পাশাপাশি অতিরিক্ত মুনাফা করছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটা তো তারা করতে পারে না। এ বছরও তাদের ৪ হাজার কোটি টাকার মুনাফার প্রাক্কলন রয়েছে।

যেখানে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে, সেখানে কীভাবে তারা এটা করতে পারে? তাছাড়া জ্বালানি তেলের দাম যেভাবে সমন্বয় করা হচ্ছে, সেটি মূলত ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, বিপিসির মুনাফা এগুলোকে হিসাব করে করা হচ্ছে। আসলে সরকার অন্য কোনো খাত থেকে রাজস্ব আয় করতে পারছে না, যে কারণে আয়ের জন্য বিপিসির ওপর নির্ভর করা হচ্ছে।

একই বক্তব্য কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলমেরও। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের কথা বলে বিপিসির মুনাফা, সরকারের রাজস্ব, ডিভিডেন্ড, করপোরেট ট্যাক্স এগুলো তুলে নিচ্ছে। এগুলোর কোনো পর্যালোচনা হচ্ছে না। এটাকে কোনোভাবেই সমন্বয় বলা যায় না। যতবারই মূল্য বেড়েছে ততবারই তারা (সরকার) সমন্বয় শব্দটা ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্রীয় ও জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিপিসির এমন চরিত্র ভয়ংকর। জনগণের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সে জনগণের কাছ থেকে মুনাফা করছে। এটা কখনো হতে পারে না। সমন্বয়ের নামে মুনাফার সঙ্গে তারা করপোরেট ট্যাক্সও জুড়ে দিচ্ছে। ৪৭ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করার পরও বিপিসি ব্যয় সমন্বয় না করে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় কীভাবে করে!

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে পেট্রোলিয়াম পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে রিফাইনারি থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে ১০ ধরনের খরচ ধরা হয়। এর মধ্যে শুরুতে রিফাইনারি থেকে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের মূল্য যথাক্রমে লিটারপ্রতি ৯৯ টাকা ৫৫ পয়সা, ১০০ টাকা ৩৮ পয়সা, ১১৬ টাকা ও ১১৯ টাকা ৮২ পয়সা। এরপর ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক, জ্বালানি তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর মার্জিন, সমান পরিবহন ভাড়া তহবিল, বিপিসির উন্নয়ন তহবিল, ‍মূল স্থাপনা কেন্দ্র, বিভিন্ন ডিপো, ডিলারদের স্থানীয় পরিবহন খরচ (ডিপোর ৪০ কিলোমিটারের ভেতরে), ডিলার এজেন্ট কমিশন অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন ধাপে এ খরচ বেড়ে যাওয়ায় রিফাইনারি থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে ডিজেলে লিটারপ্রতি ৮ টাকা ২৪ পয়সা, কেরোসিনে ৭ টাকা ৩৭ পয়সা, অকটেনে ১১ টাকা ১৮ পয়সা এবং পেট্রলে ১১ টাকা বেড়ে যাচ্ছে বলে দাবি করছেন জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা।

জ্বালানি বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, জ্বালানি তেল আমদানিতে বিশ্ববাজারের দামটি সবাই হিসাব করছে। আসলে পণ্যটি আমদানির পর ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে যে কয়েক ধাপের ব্যয় রয়েছে, সে ব্যয় কেউ ধরছে না। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জ্বালানি দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা জানিয়েছে। সেটিও এ প্রক্রিয়ার একটা অংশ। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর ভেতর দিয়ে যেতেই হবে। এক্ষেত্রে বিপিসি অতিরিক্ত মুনাফা করছে—এ ধারণা সত্য নয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top