এছাড়া ঋণের শর্ত পাল্টে প্রিমিয়ামসহ মোট বিনিয়োগের বদলে শুধু ফেইসভ্যালুর (অভিহিত দর ১০ টাকা) ওপর সুদ আরোপ করায় ব্যাংকের ক্ষতির অংক ১৭৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের দপ্তর বলছে, উচ্চ দরে শেয়ার কেনা এবং দুর্বল কোম্পানিতে সোনালী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়ায় আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায় এড়াতে পারে না বাংলাদেশ ব্যাংক।
জাতীয় সংসদে জমা দেওয়া কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সোনালী ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে এমন পর্যবেক্ষণ এসেছে। ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের জুন সময় পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ঋণ তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
পাঁচ তারকা হোটেল লো মেরিডিয়ানের মালিকানায় রয়েছে বেস্ট হোল্ডিংস। হোটেল নির্মাণ ও পরিচালনা করতে বিনিয়োগ নিয়েছে কোম্পানিটি। এর বাইরে ম্যারিয়ট ভালুকা ও লাক্সারি কালেকশন ভালুকাসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প পরিচালনা করছে বেস্ট হোল্ডিংস। মূল প্রতিষ্ঠানের শেয়ার থাকায় সোনালী ব্যাংকের বিনিয়োগ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও রয়েছে। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকের আমানত ঝুঁকিপূর্ণ করা হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের দপ্তর।
বিনিয়োগ অনুমোদন দেওয়ার সময়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। তার মোবাইল নম্বরে কয়েকদিন কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বলেন, অডিটর জেনারেলের প্রতিবেদন নিয়ে তো কোনো মন্তব্য করা যায় না। ওটা তো সরকারি রিপোর্ট। বিনিয়োগ নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত জানতে চাইলেও তিনি এড়িয়ে যান।
উচ্চ দরে প্লেসমেন্ট শেয়ার, ক্ষতি ৪২৩ কোটি ৭ লাখ
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সভায় ৬৫ টাকা দরে বেস্ট হোল্ডিংসয়ের প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত হয়। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারে প্রিমিয়াম ধরা হয় ৫৫ টাকা। সাত কোটি ৬৯ লাখ ২৩ হাজার ১০০টি শেয়ারের বিপরীতে সোনালী ব্যাংক বিনিয়োগ করে ৫০০ কোটি এক হাজার ৫০০ টাকা।
অথচ বেস্ট হোল্ডিংস নিজের সহযোগী কোম্পানির কাছে প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকার অভিহিত দরেই বিক্রি করেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সেই সহযোগী কোম্পানির নাম উল্লেখ না করে বলা হয়, এই দরে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ১৫ কোটি ৮৬ লাখ ও আরেক প্রতিষ্ঠানের ২৬ কোটি ৩৩ লাখ শেয়ার বিক্রি করা হয়।
তবে বেস্ট হোল্ডিংসের আর্থিক প্রতিবেদন সেই দুই সহযোগী কোম্পানির নাম এসেছে। সেগুলো হল আইকনএক্স হোটেলস লিমিটেড ও ধামশুর ইকোনমিক জোন লিমিটেড। দুটি কোম্পানিরই ৫১ শতাংশ করে শেয়ার ধারণ করছে বেস্ট হোল্ডিংস।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেস্ট হোল্ডিংসয়ের প্রতি শেয়ারে ৫৫ টাকা প্রিমিয়াম দেওয়ায় সোনালী ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ৪২৩ কোটি ৭ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ টাকা।
ওই সময়ে বেস্ট হোল্ডিংসয়ের পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র আট কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে দায় ছিল দুই হাজার ৪৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যদিও কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ছিল এক হাজার কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ব্যাংকের আমানতকে ঝুঁকিপূর্ণ করা হয়েছে।”
অন্যদের কাছে ১০ টাকা ও সোনালীর কাছে ৬৫ টাকা দরে শেয়ার বিক্রির বিষয়ে প্রশ্ন করলে বেস্ট হোল্ডিংসয়ের শেয়ার বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা সাজ্জাদুল কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্লেসমেন্ট শেয়ার ৬৫ টাকা দরেই বিক্রি করা হয়েছে সকলের কাছে। এর আগে শুধু উদ্যোক্তাদের জন্য শেয়ারদর ছিল ১০ টাকা।”
‘অনিয়মে’ আটকা, পরে তালিকাভুক্তি ২০২৪ সালে
সম্পদ মূল্য বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ নিয়েও পুঁজিবাজারে আসতে চেয়েছিল বেস্ট হেল্ডিংস। মেট্রো গ্রুপের একটি সহযোগী কোম্পানি হিসেবে ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করা বেস্ট হোল্ডিংসের ব্যবসা রয়েছে নির্মাণ, রিয়েল এস্টেট, কৃষিভিত্তিক শিল্প, হসপিটালিটি ও বিজ্ঞাপনী বাজারে।
বেস্ট হোল্ডিংসের ৫২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশের মালিকানা রয়েছে ব্যক্তি এবং কিছু প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির হাতে। আর বাকি ৪৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক প্লেসমেন্ট শেয়ার হোল্ডাররা, যার মধ্যে ২৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ মালিকানা রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক- সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালীর হাতে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার আছে দাবি করে ২০২০ সরাসরি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চেয়েছিল বেস্ট হোল্ডিংস।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, বেসরকারি কোনো কোম্পানির পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই নিয়ম এড়িয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ২৮৩ কোটি টাকা তোলার জন্য আবেদন করেছিল বেস্ট হোল্ডিংস।
পাশাপাশি নির্মাণ খাতের কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে নিয়ম শিথিলের সুপারিশ করে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর একটি চিঠিকেও তারা যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
তবে ডিএসই পর্ষদ সভায় ওই আবেদন নিয়ে আলোচনার আগেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কয়েকটি আইনি প্রশ্ন তুলে বেস্ট হোল্ডিংসের তালিকাভুক্তির কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়। বিতর্ক ওঠায় অর্থমন্ত্রীর স্বাক্ষরে পাঠানো চিঠির কার্যকারিতাও স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয় মন্ত্রীর দপ্তর থেকে।
২০১৯ সালে সোনালী ব্যাংকের বিনিয়োগ নেওয়ার সময়ে দ্রুত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছিল এ কোম্পানি। চৌধুরী নাফিজ সরাফাত চেয়ারম্যান থাকার সময় রেইস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট পুঁজিবাজারে বেস্ট হোল্ডিংসকে তালিকাভুক্ত করতে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে।
প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রিতে নানা বিতর্ক ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় মাঝপথে আটকে গিয়েছিল বেস্ট হোল্ডিংসের তালিকাভুক্তি।
পরে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শর্ত পূরণ করে এ বছরের ৬ ফ্রেব্রুয়ারি কোম্পানি পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু করে। দেরিতে তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণেও সোনালী ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে উঠে এসেছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।
পরে আইপিওর মাধ্যমে বুক বিল্ডিং পদ্ধাতিতে পুঁজিবাজার থেকে ৩৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করে বেস্ট হোল্ডিংস।
আইপিওতে আসার পরে প্রিমিয়ামসহ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ারটি বিক্রি হয়েছিল ২৪ টাকা দরে। বুক বিল্ডিং পদ্ধতি হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারিরা শেয়ার পেয়েছিল প্রতিটি ৩৫ টাকা দরে।
ডিএসইতে লেনদেনের প্রথম দিন শেয়ারটির দাম ১০ শতাংশ বেড়ে হয়েছিল ২৬ টাকা ৪০ পয়সা। সবশেষ শেয়ারটি হাতবদল হয় ২৬ টাকা ৩০ পয়সা দরে।
সোনালী ব্যাংক ৬৫ টাকা দরে প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনায় বর্তমান দরে প্রতি শেয়ারে লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩৮ টাকা ৭০ পয়সা। এ হিসাবে ৭ কোটি ৬৯ লাখ ২৩ হাজার ১০০টি শেয়ারে সোনালী ব্যাংকের বিনিয়োগের বিপরীতে বর্তমান ক্ষতি দাঁড়াচ্ছে ২৯৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
২০১৭ সালে নাকচ, অনুমোদন ২০১৯ সালে
সোনালী ব্যাংকের কাছে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ১২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ চেয়েছিল বেস্ট হোল্ডিংস। ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরে আবেদন করেছিল।
বিনিয়োগের বিপরীতে জামানত হিসেবে বন্ড দেওয়ার প্রস্তাব ছিল বেস্ট হোল্ডিংসয়ের। আবেদনের দুই মাস পরে মার্চের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় প্রস্তাবটি নাকচ করে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ।
ওই সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে পর্ষদ বলেছিল, প্রকল্পের মুনাফা ছিল ঋণাত্মক। তাছাড়া দাখিল করা আর্থিক বিবরণ অনুযায়ী ওই বিনিয়োগ লাভজনক বলে মনে হয়নি। সে সময় কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র এক কোটি টাকা।
প্রথম প্রস্তবে লো মেরিডিয়ান হোটেলের চলতি সম্পদ মূল্য ১ হাজার ১২৬ কোটি টাকা থেকে পুনর্মূল্যায়ন করে ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। সম্পদ মূল্য প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে দেখাতে সময় বিবেচনা করা হয়নি বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত কোম্পানির পুনর্মূল্যায়নকৃত রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। পুনর্মূল্যায়িত রিজার্ভ হিসাবে না আনলে হোটেলের আয় ঋণাত্মক হয়। পুঁজির চেয়ে কোম্পানির নেওয়া ঋণের পরিমাণ বেশি থাকাও বিনিয়োগ প্রস্তাব নাকচ করার একটি কারণ ছিল।
মুনাফা বের করার বিষয়ে হোটেলটি তাদের প্রস্তাবে বলেছিল, আয় দিয়ে বন্ড ও বন্ডের সুদ ব্যয় পরিশোধ করা হবে। কিন্তু মৌসুম ও রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় হোটেল ব্যবসা যে ঝুঁকিপূর্ণ একটি খাত, তাদের প্রস্তাবে তার উল্লেখ ছিল না নিরীক্ষায় উঠে এসেছে।
লো মেরিডিয়ান হোটেলের স্থানটি রাজউকের কাছ থেকে লিজ নেওয়া। লিজ নেওয়া সম্পত্তিকে বন্ধক রেখে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছিল বেস্ট হোল্ডিংস।
রাজউকের অনুমতি নিয়ে বন্ধক ছাড়িয়ে বন্ডের বিপরীতে ১৮০ দিনের জন্য রি-মর্টগেজ প্রস্তাব করেছিল সোনালী ব্যাংকের কাছে। এমন প্রস্তাবনা ঝুঁকিপূর্ণ বলেছিল ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ। বেস্ট হোল্ঢিংসের মালিকানাধীন লো মেরিডিয়ান হোটেল।
একই ঝুঁকি থাকার পরও ২০১৯ সালে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ বেস্ট হোল্ডিংসের প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনার অনুমোদন দেয়। ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর বিনিয়োগ অনুমোদন করার পাঁচ দিনের মাথায় ১৫ ডিসেম্বর পুরো অর্থ পরিশোধ করে সোনালী ব্যাংক।
‘অতিরঞ্জিত’ আর্থিক প্রতিবেদন
প্রথম বিনিয়োগ আবেদনে লো মেরিডিয়ানের ক্ষতির (লোকসান) অংক ৭৭ কোটি ৫৫ লাখ ও রিটেইন আর্নিং (পুঞ্জীভূত আয়) ঋণাত্মক ৪৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা দেখানো হয়েছিল। দুই বছর পর ২০১৯ সালে আবেদনের সময়ে ওই বছরের জুন পর্যন্ত ২ কোটি ১৭ লাখ টাকা লাভ ও রিটেইন আর্নিং ৩৬ কোটি ১০ লাখ টাকা দেখানো হয়।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, “আর্থিক প্রতিবেদনে অতিরঞ্জিত করে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো দেখানো হয়েছে।”
সম্পদ মূল্য ও পুঁজির বিপরীতে ঋণ অনুপাত বিবেচনায় নিলে প্রিমিয়ামসহ ৬৫ টাকা দরে প্রতি শেয়ার কেনার ‘কোনো যৌক্তিকতা নেই’ বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের দপ্তর।
যে কোনো ঋণ বা বিনিয়োগ প্রস্তাব পরিচালনা পর্ষদে উপস্থানের আগে ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটির মূল্যায়ন নিতে হয়। ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ কমিটির সদস্য। সোনালী ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটিও এ বিনিয়োগকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলেছিল।
‘দায় এড়াতে পারে না’ বাংলাদেশ ব্যাংক
বেস্ট হোল্ডিংসের শেয়ারে বিনিয়োগের বিষয়ে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েছিল সোনালী ব্যাংক। ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর সোনালী পর্ষদের সভায় বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। পরদিনই, অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে অনাপত্তি দেয়।
সরকারের নীরিক্ষায় বলা হয়েছে, “বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও অনাপত্তি প্রদান করায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক তার দায় এড়াতে পারে না।”
দুই বছর পার হলেও এ বিনিয়োগ থেকে এক টাকাও আয় করতে পারেনি সোনালী ব্যাংক। চুক্তি অনুযায়ী, লো মেরেডিয়ানের পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকের প্রতিনিধি নিযুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আড়াই বছরেও পর্ষদে স্থান পায়নি সোনালী ব্যাংকের কোনো প্রতিনিধি।
এ বিষয়ে বেস্ট হোল্ডিংসের কর্মকর্তা সাজ্জাদুল কবির দাবি করেছেন, ব্যাংকের চিঠি পাওয়ার পরে সোনালী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুভাষ চন্দ্র দাস কোম্পনির পরিচালক পদে রয়েছেন। তবে, কোম্পানির ওয়েবসাইটে যে তিন পরিচালকের নাম-পরিচয় দেওয়া আছে, সেখানে সুভাষ চন্দ্র দাসের নাম নেই। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারেননি সাজ্জাদুল কবির।
ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির। তাকেও একাধিকবার ফোন করে কোনো সাড়া পায়নি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। গত ১৫ জুলাই বিষয়টি জানিয়ে কথা বলতে চেয়ে সাবেক গভর্নরকে এসএমএস দেওয়া হয়। সব শেষ গত ১৭ জুলাই পুনরায় কল দিলে তিনি ফের লিখিত আকারে জানতে চান।
অডিটর জেনারেলের প্রতিবেদন ও বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থা জানিয়ে এসএমএস দিয়ে পুনরায় জানানো হলেও কোনো উত্তর দেননি ফজলে কবির। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক কোনো বক্তব্য দেননি।
পুরো বিনিয়োগে সুদ নয়
বিনিয়োগ মঞ্জুরিপত্রে শর্ত ছিল, পুরো বিনিয়োগ, অর্থাৎ ৫০০ কোটি এক হাজার ৫০০ টাকার উপর ১০ শতাংশ হারে সুদ প্রযোজ্য হবে। কিন্তু অর্থ ছাড়ের পর ২০২১ সাল পর্যন্ত এর বিপরীতে কোনো সুদ পায়নি সোনালী ব্যাংক।
পরে মোট বিনিয়োগ থেকে প্রিমিয়াম বাবদ দেওয়া অর্থের বদলে শুধু অভিহিত মূল্যর উপর সুদ ধরার প্রস্তাব দেয় বেস্ট হোল্ডিংস। তাতে ৫০০ কোটি টাকার বদলে মাত্র ৭৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা বিনিয়োগের উপর সুদ ধরার প্রস্তাব হয়। সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সভা তা গ্রহণও করে।
এ বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, “ব্যাংকের স্বার্থ পরিপন্থিভাবে পরিচালনা পর্ষদের ৭৪৮তম সভায় লক ইন পিরিয়ড (শেয়ার বিক্রি না করার নির্দিষ্ট মেয়াদ) পর্যন্ত ১০ শতাংশ হারে সুদ আদায়ের পরিবর্তে অভিহিত মূল্যের উপর ১০ শতাংশ হারে সুদ আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয় সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পরিষদ।”
মোট বিনিয়োগের ওপর সুদহার ধরলে ব্যাংকের সুদ আসার কথা ৫০ কোটি টাকা। নতুন প্রস্তাবে মাত্র ছয় কোটি ৫৯ লাখ টাকা আদায় করতে পারবে সোনালী ব্যাংক।
এমন সিদ্ধান্তে আড়াই বছরে ব্যাংকের সুদ বাবদ আয়ে ৪৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে সোনালী ব্যাংকের। বর্তমানেও একই হারে সুদ নির্ধারণ করছে সোনালী ব্যাংক। তাতে ২০২১ সালের জুন পরবর্তী তিন বছরে সুদ বাবদ সোনালীর ক্ষতির অংকে যোগ হবে আরো ১৩০ কোটি টাকার বেশি।
বেস্ট হোল্ডিংসয়ে বিনিয়োগ ও শর্ত বদলানোতে ২০১৭ সালের পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত এবং ২০১৯ সালে ঋণ মঞ্জুরিপত্রের শর্ত লঙ্ঘন হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে সরকারি নিরীক্ষক দপ্তর।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বেস্ট হোল্ডিংসয়ের কর্মকর্তা সাজ্জাদুল কবির বলেন, “কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে হোটেল ব্যবসায় ধস নেমেছিল ২০২০ সালে। তার প্রভাব কাটাতে অনেক সময় লেগেছে। এ কারণে ব্যাংকের সুদ ব্যয় অনেক জমেছিল। খেলাপি না হতে সুদহার ফেসভেল্যু অর্থের উপর ধরতে প্রস্তাব দেওয়া হয়।
“সোনালী ব্যাংক তো তা অনুমোদন দিয়েছে। আমরা তো কোনো অনিয়ম করিনি, সবকিছু ব্যাংকের পর্ষদ জানে। সবার কাছে ব্যখ্যাও দিয়েছি।”
তিনি বলেন, “এখন লো মেরিডিয়ান ভালো ব্যবসা করছে, আমাদের আরো কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষের পথে আছে। তার মধ্যে আরো হোটেল রয়েছে। এসব চালু হলে আয় আরো বাড়েবে।”
হোটেল ব্যবসা এখন ভালো হলে আগের সুদের হারে না ফেরার কারণ জানতে চাইলে সাজ্জাদুল কবির বলেন, “এখন ব্যাংক ও কোম্পানি পর্ষদ মিলে যে সিদ্ধান্ত নেবে তা বাস্তবায়ন হবে।”
ব্যাংকের নিরীক্ষকের জবাব গ্রহণ করেননি অডিটর জেনারেল
এই বিনিয়োগের বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল অডিটর জেনারেল। জবাবে ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত সার্কুলার অনুসরণ করে শেয়ার মূল্য ৮২ টাকা ৯৭ পয়সা দাঁড়ায়, যা কনজারভেটিভ অ্যাপ্রোচ (রক্ষণশীল নীতি) অনুসরণ করে ৬৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়।
“২০১৬ সালে ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা হলেও দ্বিতীয়বারে ২০১৯ সালে আবেদন বিবেচনাকালীন সময়ে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ছিল ৫৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। ঋণ মঞ্জুরিপত্রের শর্ত পালনে ডকুমেন্টেশন ক্রিয়েশন ও ব্যাংকের প্রতিনিধি বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে পত্র দেওয়া হয়েছে বেস্ট হোল্ডিংসকে।”
ব্যাংক মনোনীত নিরীক্ষকের জবাব গ্রহণ না করে অডিটর জেনারেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য প্রতিষ্ঠানের জবাব ‘সহায়ক নয়’।
“প্লেসমেন্ট শেয়ার ক্রয়ের সময় তার পেইডআপ ক্যাপিটাল ও বহিঃদায় বিবেচ্য বিষয় ছিল, পরবর্তী সময়ে ব্যালেন্স শিটে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন নতুন মূল্যায়নে প্রয়োজনীয়। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে ক্রয় করা হয়েছে।”
‘অতিরিক্ত’ দরে শেয়ার কেনা, ‘অস্বাভাবিক’ রিভ্যালুয়েশন রিজার্ভকে বিবেচনায় নেওয়া, যথাসময়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হতে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, “মঞ্জুরিপত্রের শর্ত পরিপালন না করায় ব্যাংকের আমানতকে ঝুঁকির মধ্যে রাখা হয়েছে।’’
এ আর্থিক অনিয়মকে ‘গুরুতর’ হিসেবে বর্ণনা করে সোনালী ব্যাংকের নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট-এআইআর’ জারি করে অডিটর জেনারেল। ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে বিষয়টি জানানোও হয়। পরে একই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি তাগাদাপত্র দেওয়া হয়।
কোনো উত্তর না পেয়ে মার্চের ৮ তারিখে আধাসরকারি পত্র দিয়েও নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো জবাব পায়নি অডিটর জেনারেলের দপ্তর। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, অনিয়মের বিষয়ে ‘দায়দায়িত্ব নির্ধারণ ও ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে আপত্তিকৃত অর্থ সুদাসলে আদায় করা আবশ্যক’।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।