শাহীনুর ইসলাম শানু: সিকদার পরিবারের মুঠো থেকে বেরিয়ে কেডিএস গ্রুপের তত্ত্বাবধানে এখন ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল)। পরিচালনা পর্ষদে সিকদার পরিবার একযুগ বিশেষ প্রভাব বিস্তার করলেও এখন আর তারা নেই। না থাকায় শুদ্ধাচার কৌশলে লোকসান অর্ধেক কমিয়ে ফেলেছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকটি। একইসঙ্গে গত ছয় মাসে অনাদায়ী বা মন্দ ঋণের পরিমাণও কমিয়ে ফেলেছে।
মিলেমিশে বেনামিতে দেয়া ঋণে বিপর্যস্ত ছিল বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংক। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে বড় পরিবর্তন আসে। সে বছরে ব্যাংকটির কর্তৃত্ব চলে যায় সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কাছে। তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজন ও দলীয় নেতাদের পর্ষদে যুক্ত করে ব্যাংকটির একক নিয়ন্ত্রণ নেয় সিকদার পরিবার। এরপর শুরু হয় অনিয়ম। এ সময়ই ব্যাংক ছাড়তে শুরু করেন ভালো উদ্যোক্তারা। খারাপ হতে শুরু করে ব্যাংকটির অবস্থা। অন্যদিকে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে সিকদার পরিবারের সম্পদ।
গত দুই বছরে ব্যাংকটির নিট লোকসান হয়েছে ৪ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে গত তিন বছর ধরে বড় অঙ্কের ঋণ প্রদান বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সিকদার গ্রুপের এক যুগ শোষণের পরে নতুন দায়িত্ব পেয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান কেডিএস গ্রুপ। এনবিএলের বর্তমানে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন খলিলুর রহমান।
এই গ্রুপের পোশাক খাতের কোম্পানি কেডিএস এক্সেসরিজ লিমিটেড ২০১৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। ব্যাংকের ইনকাম গ্রথ, নতুন পলিসি ও সম্ভাবনাসহ আরও তথ্য জানতে তাকে ফোন দেওয়া হলে রিসিভ করেননি তিনি। নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের পরে ‘নগদ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা খেলাপি আদায় করা হয়েছে’ বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌহিদুল আলম খান।
মোবাইল ফোনে বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ২০২১ সাল পরবর্তী দুই বছরে ব্যাংক মুনাফা করতে পারেনি; দুই বছরে লোকসান হয়েছে। তবে প্রথম বছরের তুলনায় দ্বিতীয় বছরে লোকসানের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আশা করছি, তা আরও কমানো সম্ভব হবে এবং মুনাফায় ফিরবে ব্যাংক।
তিনি আরও বলেন, গত ছয় মাসে আমরা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের টাকা উত্তোলন করতে পেরেছি। সব মিলে বেশ সম্ভাবনার দিকে যাচ্ছে এনবিএল।
বেনামি ঋণ ও পর্যবেক্ষক নিয়োগ
সিকদার পরিবারের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল ন্যাশনাল ব্যাংকের ভবিষ্যৎ। এরপরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বেনামি ঋণের নানা ঘটনা বেরিয়ে আসলে (২০০৯ সালে পর) প্রায় ৬ বছর পর ২০১৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।
তারপরে বিভিন্ন পক্ষের অর্থ লোপাটে আরও খারাপ হয় ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি। খেলাপি ঋণ ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে ২০০৯ সালে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি টাকার কম, এখন তা বেড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সর্বশেষ হিসাবে, ন্যাশনাল ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ২৯ শতাংশই খেলাপি। গত দুই বছরে তাদের নিট লোকসান ৪ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে গত তিন বছর ধরে বড় অঙ্কের ঋণ প্রদান বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এনবিএল দুর্বল ব্যাংক হিসেবে বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সঙ্গে একীভূত করার পরামর্শ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ন্যাশনাল ব্যাংক তাতে সায় না দেওয়ায় ভেস্তে গেছে।
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাবেক অর্থমন্ত্রী আজিজুর রহমান মল্লিক
বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর একটি ন্যাশনাল ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়া এ ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আজিজুর রহমান মল্লিক। ব্যাংকটিতে তাঁর কোনো শেয়ার না থাকার পরও উদ্যোক্তারা তাঁকে শুরুতে ১০ বছর চেয়ারম্যান পদে রেখেছিলেন। এরপর শেয়ারধারীরা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। তখনো ভালো ব্যাংক হিসেবেই ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচিতি ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের অনিরীক্ষিত আর্থিক
বিবরণ খেলাপি ঋণের কারণে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ব্যাংকটির মোট লোকসান বাড়ে ৭১ শতাংশ। অর্থাৎ লোকসান হয়েছে এক হাজার ৬৩ কোটি টাকা। গত ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরের তিন মাসে ব্যাংকের লোকসান হয়েছে ২৯৮ কোটি টাকা। তবে তার আগের বছরে একই সময়ের তুলনায় লোকসান কমেছে চার দশমিক ১৮ শতাংশ কম। ২০২২ সালে ছিল সর্বোচ্চ লোকসান তিন হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। এরপর ২০২৩ সালে লোকসান অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে আনা হয়েছে এক হাজার ৪৯৭ কোটি টাকায়।
ব্যাংকের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৩৮৮ কোটি টাকা, গত ডিসেম্বরে যা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা।
লোকসানি এনবিএল লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ
১৯৮৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে এনবিএল। তালিকাভুক্তির পরে ২০২০ সাল পর্যন্ত বোনাস শেয়ার দিয়ে মূলধন বৃদ্ধি করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালে মাত্র এবার পুঁজিবাজারের ইতিহাসে নগদ লভ্যাংশ প্রদান করে এনবিএল। নিয়মিত বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিলেও পরবর্তী সময়ে দিতে তা ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি দর ছিল ৬.৬০ টাকা।
সিকদার গ্রুপের দ্বন্দ্বে ব্যাংক পরিচালনায় নতুন পর্ষদ
সিকদার গ্রুপের গঠিত পরিচালনা পর্ষদে দ্বন্দ্বের কারণে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংকের বিদ্যমান পর্ষদ ভেঙে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর চলতি বছরের মে মাসে নতুন পর্ষদও গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং ব্যাংকিং সুশাসন নিশ্চিতকল্পে ও জনস্বার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নতুনভাবে গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় উদ্যোক্তা পরিচালক এবং কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান। বোর্ডের অন্য নতুন সদস্যরা হলেন ন্যাশনাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রতিনিধি পরিচালকের মধ্যে রয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. সফিকুর রহমান, প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ রিয়াজুল করিম (এফসিএমএ), ব্যবসায়ী এরশাদ মাহমুদ, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এহসানুল করিম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম তফাজ্জল হক। স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দীন নিজামী, ড. রত্না দত্ত (এফসিএ) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবিএম জহুরুল হুদা। আগের পর্ষদের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বাদে আর কাউকে নতুন পর্ষদে রাখা হয়নি।
ব্যাংকটির পর্ষদ থেকে মনোয়ারা সিকদার, রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার, নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া ও মুরশিদ কুলি খানকে বাদ দেওয়া হয়। কেবল সিকদার গ্রুপ থেকে পারভীন হক সিকদারকে পরিচালক রাখা হলে পরে তাঁকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ সিকদার গ্রুপের বাইরে চলে যায়।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।