জনস্রোতের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারে পতন ঘটে। সেই আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে। উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতো সরকারি ও বেসরকারি দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো। একইসঙ্গে অর্থ পাচার নানান অপকর্মের জের দওে বেসকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে চলছে বিক্ষোভ।
বেসরকারি অনেক ব্যাংকে চলছে মালিকানা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানসহ সহযোগীদের প্রত্যাহার করে বিচারের আওতায় আনা ও বাংলাদেশ ব্যাংকে গর্ণরসহ ডেপুটি গভর্নরদের প্রত্যাহার করে অনৈতিক কাজের জন্য বিচারের মুখোমুখি করা। রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানরা সাবেক সরকারের কৃপায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন বলে কর্মচারীদের অভিযোগ।
ব্যাংকের মালিকানা পুনরুদ্ধারে প্রথম চেষ্টা শামিল হয় ইসলামী ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থপাচারে সহায়তাকারীদের অপসারণ ও অবৈধ নিয়োগ বাতিল, চাকরিতে পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ চলছে। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকেও বুধবার নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়েছে। যার ফলে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ ডেপুটি গভর্নররা আসেন।
মালিকানা ফিরে পেতে বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), ওয়ান ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), বাংলাদেশ কমার্সসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে বুধবার থেকে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করছেন।
মালিকানা পুনরুদ্ধারে চেষ্টায় ইসলামী ব্যাংক
বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে উঠেছে প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলো। তারমধ্যে বেসরকরি খাতের ইসলামী ব্যাংকে গত কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। ইতোমধ্যে ব্যাংক দখলকারী এস আলম গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের ৮৮৯ কোটি টাকা অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক।
একইসঙ্গে রাজধানীর দিলকুশায় ব্যাংকের কেন্দ্রিয় কার্যালয়ে এস আলম গ্রুপের নিয়াগ করা কর্মীদের মঙ্গলবার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তারা জানায়, ২০১৭ সালের পরে এস আলম গ্রুপ ব্যাংকে যে সব নিয়োগ দিয়েছে তা বাতিল করা হয়েছে। একইসঙ্গে ২০১৭ সালের আগে যাদের অবৈধভাবে চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে তাদের সেদিন থেকেই চাকরিতে পূর্নবহাল করা হবে।
ইউসিবি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ
বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংককে (ইউসিবি) সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন ব্যাংকের দেড় শতাধিক শেয়ারধারী। সকালে গুলশানে ইউসিবির প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে তাঁরা এই দাবি জানান। এই সময় তাঁরা বিভিন্ন ফেস্টুন প্রদর্শন করে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থ পাচার’ ও ব্যাংকটির নানা অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করেন।
ইউসিবির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বাবা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী। শুরু থেকে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম এ হাসেম। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত উভয়ের পরিবারের সদস্যরাই ব্যাংকটিতে যুক্ত ছিলেন ও নেতৃত্ব দেন।
ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে পারটেক্স গ্রুপের মালিক পরিবারের সদস্যদের ইউসিবি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। ব্যাংকটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুকমিলা জামান। তবে রুকমিলা জামান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় ব্যাংকটি মূলত সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিচালনা করেন, এমনটাই জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে ব্যাংকটির কিছু শেয়ারধারী জানিয়েছেন, রুকমিলা জামান ব্যাংকের চেয়ারপারসন হলেও সাইফুজ্জামান চৌধুরী কার্যত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁর ‘স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটের কারণে’ ব্যাংকটি দেউলিয়া হওয়ার পথে। চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ১ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে, যা এই ‘ব্যাংকের আমানতকারীদের টাকা লুট করে পরিশোধ করা হয়েছে’।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আসেন গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গতকালও অফিসে আসেননি। তিনি কোথায় আছেন তাও জানেন না কর্মকর্তারা। বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউ প্রধান ও নীতি উপদেষ্টাকে বের করে দেওয়া হয়। তারা কেউ গতকাল আর অফিসে আসেননি। এতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি গ্রহণেও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে, অর্থ পাচার ঠেকাতে চিফ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কমপ্লায়েন্স অফিসারদের ডেকেছে কেন্দ্রীয় ভ্যাংকের বিএফআইইউ। অর্থ পাচার ঠেকানোর বিষয়ে আলোচনার জন্য দেশের সব রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের চিফ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কমপ্লায়েন্স’ অফিসারদের ডেকেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টা এবং বিকাল ৩টায় দুই দফায় এ বৈঠক হবে বলে বুধবার সব ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে জানানো হয়েছে।
পরিস্থির সার্বিক উন্নয়ন সম্পর্কে ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার বলেন, পরিস্থিতি পরিবর্তন ঘটলে আরও অনেক বিষয়ে পরিবর্তন আসে। এখানেও পরিবর্তন আসবে। খেলাপি ঋণ নিয়ে নানা রকমের আইন রয়েছে। তবে নানা চাপের কারণে এটা প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। তবে সামনে এ বিষয়ে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আমি মনে করি।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।