সকল মেনু

ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপ ঘিরে অসন্তোষের ঝড়

শাহীনুর ইসলাম শানু: ১৯৮৩ সালে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। যা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও সেরা ব্যাংক হিসেবে ২০২০ সাল পর্যন্ত শীর্ষে ছিল। সেই গর্বিত ব্যাংকটি দুর্গতির মুলে আওয়ামী লীগ সরকারের ছায়ায় বেড়ে ওঠা এস আলম গ্রুপ।

সেই ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের পরীক্ষাবিহীন নিয়োগ দেয়া কর্মীদের অবৈধ বলে গতকাল প্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে এনিয়ে বইছে অসন্তোসের ঝড়। রাজধানীর দিলকুশায় মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তাদের প্রবেশে বাধা দেয়ায় বিক্ষোভ করা হয়েছে।

ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১৭ সালের পর থেকে অবৈধভাবে পরীক্ষাবিহীন সব নিয়োগ বাতিল করা হবে। একইসঙ্গে যাদের অবৈধভাবে চাকরি বাতিল করা হয়েছে তাদের চাকরি ফেরত দেয়া হবে। যারা গত সাত বছরে প্রমোশন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের যথাযথ প্রমোশন ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

জামায়াতে ইসলামীর তৈরি ইসলামী ব্যাংকটি জামায়াতমুক্ত করতে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৬ সালের ২ জুনে কাজ শুরু করে। প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে ২০১৭ সালে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এই সময় থেকে দেশের শরীয়াভিত্তিক বেশ কয়েকটি ব্যাংকের নেতৃত্বে রয়েছে গ্রুপটি।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকারের শুরু এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন হয়। পট পরিবর্তনের পরদিনই রাজধানীর দিলকুশায় ব্যাংকটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে উত্তেজনার শুরু হয়। কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন সুবিধাবঞ্চিত অনেক কর্মকর্তা। তাদের অভিযোগ, এস আলম গ্রুপ তাদের নিয়োগ দিয়েছে বলে ব্যাংকে প্রবেশে নিষেধ করা হয়েছে। অন্যদিকে, ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড কর্তৃপক্ষ জানায়, বিভিন্ন অনিয়মের কারণে তাদের চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের পর ব্যাংকের সব নিয়োগ বাতিল হওয়ায় তাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

২০০৯ সালে প্রথম সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপর প্রথমেই সুবিধা নেয় শিকদার পরিবার। মিলে মিশে প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংক দখল নিয়ে লুট করে। ব্যাংকটির কর্তৃত্ব চলে যায় সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কাছে। তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজন ও দলীয় নেতাদের পর্ষদে যুক্ত করে ব্যাংকটির একক নিয়ন্ত্রণ নেয় সিকদার পরিবার।

ব্যাংক কিভাবে নিয়ন্ত্রণ নেয়
২০১১ সালের নভেম্বরে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নতুন নিয়ম করে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে হলে তাকে কোম্পানিটির ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হবে। এ বিধান করার পর ব্যাংকটিতে জামায়াতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র আধিপত্যে কিছুটা ভাটা পড়ে। পরে বিএসইসির আরো চাপে ব্যাংকের ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে শিল্পগ্রুপটি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ২০১৭ সালে শেয়ারবাজার থেকে ৭টি ব্যাংকের শেয়ার কিনে ব্যাংকের মালিকানায় চলে আসে চট্টগ্রামভিত্তিক এই গ্রুপ। এরপর ব্যাংকটিতে বাড়তে তাকে থাকে বেনামি ঋণ, বিভিন্ন অনিয়ম ও নতুন কর্মী নিয়োগের নানা ঘটনা।

ন্যাশনাল ব্যাংকের মতো দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ইসলামী ব্যাংকেও আওয়ামী লীগ সরকার নুতন করে প্রশাসক নিয়োগ এবং ব্যবস্থাপনা পর্ষদেও পরিচালক দিয়োগ দেয়। এরপর ‘মিলে মিশে’ দেশের বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট ও পাচার করে এস আলম গ্রুপ। চট্টগ্রামভিত্তিক গ্রুপটি বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ার কিনে দখল নিয়ে কর্মী নিয়োগ এবং বেনামি ঋণে অর্থ লোপাট করতে থাকে।

অনিয়মে জড়িত থাকায় তাদের অব্যহতি ও বিক্ষোভ
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশে নিষেধ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, তাদের চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। যে কারণে তারা তা মানতে না পেরে সকালে অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেন। তবে কিছুক্ষণ পরে তারা চলে গেছেন।

তিনি বলেন, আমি এই মুহূর্তে অফিসে নেই। তবে জেনেছি, তারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেছেন। তাদের বিরুদ্ধে অনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে তাদের চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়া হয়।

তবে এস আলমের নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তাদের ব্যাংকে ঢুকতে বাধা দেয়ার বিষয়টি গুজব বলেন নজরুল ইলাম। একই বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড অ্যাসিসটেন্ট ভাইস চেয়ারম্যান সুলতান উদ্দীন বলেন, তাদের ঢুকতে দেয়া হয়নি- এমন খবর প্রথম শুনলাম। বিষয়টি এমন নয়, তাদের চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে ।

নাম প্রকাশ না করা অনুরোধে ব্যাংকটির এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের নিয়োগ ছিল অবৈধ। এস আলম গ্রুপ তাদের বসিয়েছিল। তাদের কারণে বৈধ নিয়োগ পাওয়াদের পদোন্নতি দেওয়া হতো না। তারা ভুয়া লোন অনুমোদনসহ লুটপাট করে ব্যাংকটিকে দেউলিয়া করে দিয়েছে। তাদের সেই অনিয়মের প্রতিবাদ করলেই আমাদের চাকরি হারাতে হতো।

এদিকে ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের ডিএমডি রেজাউর রহমানকে মারধর করেছে আইবিবিএলের লোকজন। এছাড়া এস আলমের ‘বিশেষ কৃপায়’ প্রমোশন পাওয়া আরও অন্তত চার-পাঁচজনকে মারধর করেছে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।

অবৈধভাবে পরীক্ষাবিহীন সব নিয়োগ বাতিল
ইসলামী ব্যাংকের সিবিএ নেতা আনিসুর রহমান বলেন, ২০১৭ সালের পরে যত এক্সিকিউটিভ এসেছেন, তারা আর ব্যাংকে ঢুকতে পারবেন না। ২০১৭ সালের পর থেকে অবৈধভাবে পরীক্ষাবিহীন সব নিয়োগ বাতিল করা হবে। একইসঙ্গে সেই সময় যাদের অবৈধভাবে চাকরি বাতিল করা হয়েছে তাদের চাকরি পুনরায় দেয়া হবে। একইসাথে যারা গত সাত বছরে প্রমোশন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের যথাযথ প্রমোশন ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

ইসলামী ব্যাংকের অপারেশন ইউংয়ের হেড এসএভিপি ড. কামাল উদ্দিন জসিম বলেন, আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি ছাত্রদের মাধ্যমে। প্রজ্ঞার সঙ্গে এই অর্জন তুলে নিতে হবে। ইসলামী ব্যাংক বিশ্বের কাছে খুবই স্মরণীয়। আমাদের মর্যাদা পুনরায় ফিরে পেতে হবে, এটা আমরাই পারবো। তিনি আরো বলেন, ২০১৭ সালের পর থেকে সকল অবৈধ নিয়োগ বাতিলের কাজ অলরেডি শুরু হয়েছে।

কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার পথপ্রদর্শক’ ইসলামী ব্যাংক

‘কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার পথপ্রদর্শক’। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পসহ রপ্তানিমুখী শিল্প এবং দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের মতো নতুন নতুন খাতে ব্যাংকটি আর্থিক সেবার দুয়ার খুলেছিল। বিভিন্ন স্থানীয় শিল্প ও এসএমই দাঁড়িয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ঋণের ওপর। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শতাব্দী পুরোনো অর্থনীতিবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘দ্য ব্যাংকার’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে ২০১২-২০ সাল পর্যন্ত টানা ৯ বছর ইসলামী ব্যাংককে বিশ্বের শীর্ষ এক হাজার ব্যাংকের তালিকায় একমাত্র ও প্রথম বাংলাদেশি ব্যাংক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রতিষ্ঠাকালে এই বেসরকারি ব্যাংকের ৭০ শতাংশ পুঁজি জোগান দিয়েছিলেন বিদেশিরা।

এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ঝুঁকিতে পড়ে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top