সকল মেনু

৭৯২৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েও তথ্য গোপন

জনস্রোতে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দখলদার ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের ভেতরে দুটি পক্ষেরই দৃঢ় অস্থান। দখলদার ঠেকাতে উভয়পক্ষের অবস্থান নিয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকেও (এসআইবিএল) অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংকের ভেতরে রক্তাক্ত পরিবেশের মধ্যে বেরিয়ে এলো আরো ভয়ঙ্কর তথ্য। সাগর চুরি করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুজন ডেপুটি গভর্ণরের তত্ত্বাবধানে এসআইবিএল থেকে তথ্য গোপন করে পাহাড় সমান ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। যা এতোদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক গোপন করেছিল। গোপন সমঝোতায় ৭ হাজার ৯২৪ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে গ্রুপটি।

দুই ডেপুটির সোমবার বিদায়ের পরে এই চিত্র ফুটে ওঠে। তৃতীয়-চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংকগুলো ‘ক্লিনিক্যাল ডেথ’। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় অর্থ চুষে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। নামে-বেনামে পাহাড় সমান ঋণ নিয়ে তা ফেরত দিতে পারছে না। এভাবে ৭টি ব্যাংক দখলে নিয়ে আগ্রাসন চালিয়েছে বলে সোমবার জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) কর্মকর্তারা। স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন না থাকার এটি ভয়াবহ ফল বলেন তারা।

ঋণের তথ্য গোপন: ব্যাংকের কাছে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। প্রতিবেদনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দেখিয়েছে ১৬৪৪ কোটি টাকা। এখানে আরো ৭,৯২৪ কোটি টাকা ঋণের তথ্য গোপন করে এসআইবিএল। সেই তথ্য গোপনে সহায়তা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গোপন প্রতিবেদনে জানা গেছে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা বেনামে ঋণ দিয়ে এখন খেলাপি। অন্যদিকে প্রভিশন ঘাটতির ফলে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের ল্যভাংশ ঘোষণা করতে পারেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

গোপন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ দেখিয়েছে ১৬৪৪ কোটি টাকা। এখানে ৭৯২৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করে এসআইবিএল।

এছাড়া একই সময় নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পরিদর্শন টিম ব্যাংকটিতে প্রভিশন ঘাটতি দেখেন ৮১২৭ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি প্রতিবেদনে প্রভিশন ঘাটতি দেখিয়েছে মাত্র ৬৪ কোটি টাকা। এতে প্রভিশন ঘাটতির ৮০৬৩ কোটি টাকা গোপন করে এসআইবিএল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি পরিদর্শন টিম ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সরেজমিনে প্রধান ৫টি শাখা, অফ-সাইট ভিত্তিতে ১০টি ও ঢাকার বাইরে ৭টি শাখা পর্যবেক্ষণ করে এই তথ্য পায়।

জড়িত কারা: বিশাল অংকের খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতির এই তথ্য গোপন করতে কাজ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান। তার সঙ্গে ডেপুটি গভর্নর ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাসুদ বিশ্বাসও জড়িত বলে একঠিক সূত্র তথ্য নিশ্চিত করে। তারা সোমবার পদত্যাগ করেন। এস আলম গ্রপ থেকে এবং আওয়ামী সরকারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিএফআইইউ বিষয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পরিদর্শন করে আমরা হতবাক হয়েছি। পুকুর নয় এ যেন সাগর চুরি। যেখানে ৮১২৭ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি, সেখানে তথ্য গোপন করে মাত্র ৬৪ কোটি টাকা ঘাটতি দেখানো হয়েছে।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী জাফর আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি।

মালিকানায় কে: ২০১৭ সালে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় আসে চট্টগ্রাম ভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ। তিনি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের জামাতা। ২০১৭ সালের আগে পরিচালনা পর্ষদে বাদ পড়েন ব্যাংকটির কয়েকজন উদ্যোক্তা ও পরিচালক। বাদ পড়ারা গত রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে ব্যাংক উদ্ধারের দাবিতে মানববন্ধন শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন।

ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি নীতিমালা কি: আমানতকারীদের জমানো অর্থ দিয়ে ব্যাংক ব্যবসা করে এবং অর্থায়নকারীদের লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, ঋণের গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ব্যাংকের ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দঋণে (খেলাপি) পরিণত হলে বা আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, এজন্যই প্রভিশন রাখার বিধান রয়েছে।

কোনো ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি থাকলে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। এক সময় কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি থাকলে শুধু সতর্ক ও ঘাটতি মেটাতে দিকনির্দেশনা দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ব্যাংকে টানা দুবছর ঘাটতি থাকলে তার বড় অঙ্কের জরিমানাসহ লাইসেন্স বাতিলের কথা বলা আছে। এসব কারণে নানা উপায়ে প্রভিশন ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করে ব্যাংকগুলো।

নীতি অনুযায়ী, বর্তমানে অশ্রেণিকৃত ঋণের ধরণ অনুযায়ী দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো তাদের নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফার ০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত, ‘সাব স্ট্যান্ডার্ড’ বা নিম্নমানের শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং ‘ডাউটফুল’ সন্দেহজনক শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ আর ‘মন্দ’ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয় শতভাগ। কিন্তু এসআইবিএল তা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।

এস আলম গ্রুপ থেকে মুক্ত করতে মানববন্ধন: এস আলম গ্রুপ থেকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকমুক্ত করতে মানববন্ধন করেছে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান, পরিচালক ও শেয়ারধারীরা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের পর সংবাদ সম্মেলনে তারা অভিযোগ করেন, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে তুলে পাচার করেছেন। এতে শুধু এসআইবিএল নয়, পুরো আর্থিক খাতই হুমকির মুখে পড়েছে। সাধারণ আমানতকারীরা জমাকৃত অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতেন পারছেন না।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক, সাবেক পরিচালক আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুর রহমান, আবুল বসর ভূঁইয়াসহ সাধারণ শেয়ারধারীরা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top