দেশের ব্যাংকগুলোকে জোর জবরদস্তি করে মার্জ করা ঠিক হবে না। কারণ কর্মী, প্রযুক্তি, লক্ষ্য ও প্রস্তুতি সবার এক নয়। বাংলাদেশ এতো ব্যাংক দরকার নেই। রাজনীতিক বিবেচনায় ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইসেন্স দেয়া বন্ধ করতে হবে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুমোদন পাওয়া অধিকাংশ ব্যাংক ক্লিনিক্যাল ডেথ। এদের চলনশক্তি নেই। তার মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থা মুমূর্ষ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) অনুষ্ঠানে সোমবার এসব কথা বলেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। ঢাকার ধানমন্ডিতে সংস্থাটির কার্যালয়ে ‘ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনা, শিগগির কী করতে হবে’ শীর্ষক পর্যালোচনার সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকখাতের সমস্যা ও সুপারিশ তুলে ধরেন তিনি।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ। একইভাবে বিমা খাতও অগ্রহণযোগ্য অবস্থায় আছে বলে জানান তারা।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর নেতৃত্বে যারা থাকবেন তাদের যোগ্যতা এবং সততার ভিত্তিতে নির্বাচন করতে হবে। এজন্য আমরা আগেই স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা বলেছিলাম। তা গঠিত না হওয়ায় ভুয়া কাগজ দিয়ে অনেকে ঋণ নিয়েছে।
অনেকে জালিয়ারি মাধ্যমে ঋণ নিয়েছেÑ এমন ২৪টি তথ্য রয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। জালিয়াতি ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিতে হবে।
দেশের মূদ্রানীতি প্রণনয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ গোষ্ঠির কারণে সঠিক নীতিতে বাধা পড়েছে। তারা ব্যবসায়ীদের মুনাফা করে দিতে এই নীতি প্রণয়ণ করা হয়। যার ফলে ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫৭ বিলিয়ন ডলার বেহাত হয়েছে বলে জানান ফাহমিদা খাতুন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিকভাবে লাইসেন্স পাওয়া তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের কিছু ব্যাংক মৃতপ্রায় হয়ে আছে। এদের চলনশক্তি নেই। এদের জনগণের করের টাকা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এরা মরে যাক। এতে শুধু অর্থের অপচয় হচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাক এসব ব্যাংক।
এ ছাড়া কিছু ব্যাংকের পারফরম্যান্স খারাপ, আরেকটু ধাক্কা লাগলেই মরে যাবে। এগুলোর পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করে পরিচালনার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
সিপিডি বলেছে, পুরো ব্যাংক খাত চলে গেছে নিয়মনীতির বাইরে। এত দিন বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রসারে কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক দশকের বেশি সময় ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় ধরনের কেলেঙ্কারি হয়েছে। এসব কেলেঙ্কারির পরিমাণ ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।
অন্যদের মধ্যে সংস্থাটির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এবং গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বক্তব্য দেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়।
ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান করতে ব্যাংক কমিশন গঠন করার সুপারিশ করেছে সিপিডি। আরও বলেছে, ব্যাংক খাতে দ্বৈত প্রশাসন চলছে। বন্ধ করে দেওয়া উচিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ ছাড়া কোনো ধরনের বিবেচনা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়ার সংস্কৃতিও বন্ধ করতে হবে।
সিপিডি বলেছে, চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের হাতেই সাতটি ব্যাংক। এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। একসময় ইসলামী ব্যাংক ভালো ব্যাংক ছিল। দখলের পর তাও মুমূর্ষু হয়ে গেছে। এ ছাড়া একক গ্রাহকের জন্য ঋণসীমা নীতি লঙ্ঘন করে জনতা ব্যাংক এননট্যাক্স গ্রুপকে দিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। এভাবে একক গোষ্ঠী যদি এত বেশি পায়, অন্য গ্রাহকেরা কী পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এমন না যে তাদের স্বাধীনতা নেই; তারা এটা ব্যবহার করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বরং বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থের কথা চিন্তা করে নীতিমালা করেছে। দুই বছর ধরে দেশের মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে। দরকার ছিল সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু বিশেষ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর যাতে সুবিধা হয়, সে জন্য সুদহার বাড়ায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকখাতে বড় বড় অন্তত ২৪টি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এর মাধ্যমে লোপাট হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এ অর্থ গত অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশ। অন্যদিকে এসময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
ব্যাংকখাতকে এখনই ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এটি করা হলে অর্থনীতির বিরাট জায়গা আমরা উন্নত করতে পারবো। ব্যাংকি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব করা, নিয়মনীতি না মেনে বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়াকে ব্যাংকখাতের মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানে কোনো বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি। এর মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী শ্রেণি তৈরির জন্য ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়া হয়। এসব ব্যাংকের কোনো সক্ষমতা নেই। সেগুলো আবার সরকারি অর্থে রিক্যাপিটালাইজেশন করা হয়। সরকারি অর্থের কী ধরনের অপচয়।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসনিক দায়িত্ব যারা পালন করেছেন, অর্থাৎ গত ১৫ বছরে গভর্নর যারা ছিলেন তারা যেসব নীতিমালা নিয়েছেন, সেগুলো ব্যাংকিং নীতিমালাল সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তারা বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে অনেক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। এগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত। এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির বিষয়টির এখনো তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ করার জন্য সিআইডি ৭৯ বার সময় নিয়েছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ব্যাংকখাতের চ্যালেঞ্জগুলো আর্থিক খাতেও প্রযোজ্য। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ। একইভাবে বিমা খাতও অগ্রহণযোগ্য অবস্থায় আছে। আর্থিক খাতে সুশাসনের জন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক খাতগুলো বন্ধ করতে হবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।