সকল মেনু

সচিবালয়ে নিচে উত্তপ্ত উপরে শঙ্কার নীরবতা

প্রবল জনস্রোতে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে দেশের প্রতিটি খাতে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। ১৫ বছর বঞ্চনার প্রতিবাদে একপক্ষ মুখর, অন্যপক্ষ শীতল জলের কলসি। বুধবার, ১৪ আগস্ট বাংলাদেশের ধমনী সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিম্নশ্রেণির কর্মীদের মাঝে সেই উত্তাপ ঝরে পড়ছে।

ভেতরে উত্তাপে যোগান দিচ্ছে বিএনপিপন্থি; নীরতায় রয়েছে আওয়ামীপন্থি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। সরকার পতনের পরে গত মঙ্গলবার প্রথম উপ-সচিব পদে একসঙ্গে ১১৭ জনের পদোন্নতি ঘিরে অনেক মন্ত্রণালয়ের ভেতরে চলছে উৎসব। তবে সচিবালয়ে আগের মতো সেই কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ নেই। দর্শনার্থীদের প্রবেশ সংরক্ষিত হওয়ায় বিশেষ নীরবতা মাঝে মাঝেই ভেঙে দিচ্ছে কর্মীদের স্লোগানের ভয়ঙ্কর সব শব্দ।

অন্যদিকে মন্ত্রণালয়গুলোর শীর্ষ অধিকর্তারা হামলা ও পদ হারানোর আশঙ্কায় নীরবতা পালন করছেন। অধিকাংশ সচিব মন্ত্রণালয়ে থাকলেও তারা নির্দিষ্ট আসনে নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের নতুন নির্দেশনার দিকে তারা চেয়ে আছেন। সব কাজ স্থবির। নানান শঙ্কায় তারা অন্তরালে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন বলে সচিবদের অনেকেই এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

সচিবালয় ঘুরে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে সুনসান নীরবতা। কোনো দর্শনার্থীর ভিড় নেই। তবে ভেতরে প্রবেশের নীতি সংরক্ষণ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব জাহাঙ্গীর আলমের অবস্থান সম্পর্কে সচিবের একান্ত সচিব মো. আবু রায়হান দোলনের কাছে জানতে চাইলে ‘কক্ষে নেই’ বলে জানান। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘স্যার, মিটিংয়ে আছেন। কোথায় মিটিংয়ে আছেন, নিরাপত্তার কারণে তা বলা যাবে না’।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ের সচিব, যুগ্ম সচিব এবং অতিরিক্ত সচিবদের অধিকাংশ নির্দিষ্ট কক্ষে নেই। না থাকার কারণ হিসেবে জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে জ্বালানি বিষয়ে নতুন কি তথ্য উপস্থাপন করা যায়, সে বিষয়ে তারা আলোচনা করছেন। তবে কোথায় বসে সেই আলোচনা হচ্ছে- তা তারা প্রত্যেকে অজ্ঞাত।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহীন আক্তার প্রতিবেদককে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের দিক নির্দেশনায় অপেক্ষায় আছি। আশা করছি, তারা ভালো পদক্ষেপ নেবেন। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করবেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সামনে কণ্ঠে যেন আগুন ঝরছে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণে বিক্ষুব্ধ আর স্লোগানে উত্তাল করে তুলেছে। একইসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে ঘিরে ভিড় বাড়ছে।

অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাঙ্গীর আলমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যেন চাপা আতঙ্ক। কেউ কথা বলছেন না। সুনসান নীরবতা। কারণ খুঁজতে জানা গেল- চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া মোট ১৯ জন পূর্ণ সচিবের মধ্যে ১০ জনের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ভাস্কর দেবনাথ বাপ্পি এতে স্বাক্ষর করেছেন।

অন্যদিকে, ১৫ আগস্ট ঘিরে নতুন নির্দেশনায় হতবাগ হয়েছেন শীর্ষ অনেক কর্মকর্তা। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের তালিকায় রয়েছে- ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগের আল্টিমেটার দেওয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান সেই আবু হেনা রহমাতুল মুনিমকে পদচ্যুত করা হয়েছে। তালিকায় আরও আছেন- জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালাম, সড়ক, পরিবহন বিভাগের সচিব এবিএম আমিনুল্লাহ নুরী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের তালিকায় আরো আছেন- পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার, বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম ওয়াহিদা আক্তার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী সদস্য (সচিব) মো. খাইরুল ইসলাম। একইসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ ১১৭ কর্মকর্তাকে মঙ্গলবার পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ এসব কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দেওয়ায় তারা উৎসব করছেন।

দুপুরে দেখা যায়, আর্থিক খাতের ধমনী অর্থ মন্ত্রণালয়ে যেন উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যাংক লুটের কারিগর হিসেবে খ্যাতি পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংককে ঘিরে নানান নেতিবাচক বক্তব্য অনেকের মুখে মুখে। তাদের অনেকে বলছেন, দুর্নীতিবাজ সচিব, আইনজীবী ও ঋণ খেলাপিদের তালিকা করছে নতুন সরকার।

তবে ব্যাংকলুটের সঙ্গে যারা জড়িত বা বিশেষ সুবিধায় টাকা পাচার করেছে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরের শাস্তি হিসেবে তাদের তালিকায় রাখা হচ্ছে।

লুটের তালিকার শীর্ষে ৭টি ব্যাংক দখলকারী এস আলম গ্রুপ। মন্ত্রণালয়ে তালিকা তৈরির এমন গুঞ্জন হলেও আসলে কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। হয়তো তা গুঞ্জন হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।

সবমিলে সচিবালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মাঝে বঞ্চনার ক্ষোভ এবং অন্যদিকে আশঙ্কার নীরবতা পালন করছেন সচিবরা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top