দীর্ঘদিন ধরেই তারল্যসংকটে ধুঁকছে অনেক ব্যাংক। এস আলমের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ টাকা ধার নিয়ে চলছে। তবে এবার দেশের শরিয়াহভিত্তিক ৫ ব্যাংকসহ ৯ ব্যাংককে দেওয়া নগদ অর্থসহায়তা কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এগুলো হলো- ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্যসহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় বিপাকে পড়তে যাচ্ছে দীর্ঘদিন অর্থসংকটে থাকা এসব ব্যাংক। কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ তারল্যসহায়তা কাজে লাগিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল এসব ব্যাংক। এখন সহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় বিপাকে পড়তে পারে ব্যাংকগুলোর আমানতকারীরা।
এমন পরিস্থিতিতে ১২ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য ব্যাংকগুলোকে এই নয় ব্যাংকের এক কোটি টাকার বেশি চেক গ্রহণ না করার নির্দেশ দেয়। ফলে ওই সব ব্যাংকের আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতারা সেখান থেকে এক কোটি টাকার বেশি তুলতে পারবেন না।
তবে যে ব্যাংক চেক ইস্যু করেছে, সেখান থেকে এক কোটি টাকার বেশি তোলা যাবে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ তারল্যসহায়তার বোঝা কমাতে এ উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক প্রমিসরি নোটের বিপরীতে রুগ্ণ ব্যাংকগুলোকে বিশেষ অর্থসহায়তা দেয়। এর মাধ্যমে একপক্ষ লিখিতভাবে অন্যপক্ষকে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। টাকার অভাবে নয় ব্যাংকের বেশিরভাগই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাবের ঘাটতিতে ভুগছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত ১২ মে পর্যন্ত আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক ছাড়া বাকি ৭ ব্যাংকের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) হিসাবে মোট ৩০ হাজার ২০২ কোটি টাকা ঘাটতি আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু এসব ব্যাংকের আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতারা বড় অঙ্কের টাকা তুলতে পারবেন না, তাই তাদের নগদ টাকার সহায়তা কম লাগবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সহায়তায় এত দিন বেসরকারি ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ সহায়তা পেয়ে আসছিল। এসব ব্যাংককে কেন তারল্যসহায়তা দেওয়া হচ্ছে তা জানতে চাইলে আব্দুর রউফ তালুকদার কয়েক মাস আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এটা গভর্নরের বিবেচনার ভিত্তিতে করা হয়েছে।’
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের চার দিন পর ৯ আগস্ট পদত্যাগ করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। আর গতকালই নতুন গভর্নর হিসেবে ড. আহসান এইচ মনসুর কাজ শুরু করেছেন।
২০২২ সালের মাঝামাঝি ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে অনিয়ম ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলো ৯ প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান আবেদনপত্রে জাল ঠিকানা দিলেও ঋণগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এরই প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইসলামী ব্যাংকে আবার পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়। প্রথমবারের মতো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক পাঠায়।
সে সময় শুধু ওই ব্যাংকগুলোই নয়, অন্যান্য দুর্বল ও কেলেঙ্কারিতে আক্রান্ত ব্যাংকগুলোও বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেওয়ার চাপে পড়ে। এ কারণে সেসব ব্যাংকের তীব্র তারল্যসংকট দেখা দেয়। ২০২২ সাল থেকে ৯ ব্যাংকের বেশিরভাগই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তাদের অ্যাকাউন্টে সিআরআর ও এসএলআর (বিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত) ঘাটতিতে আছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালের শেষে তাদের উদ্বৃত্তপত্র সাজানোর জন্য ব্যাংকগুলো বেশিরভাগই ‘শেষ অবলম্বন’ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জরুরিভিত্তিতে টাকা নিয়েছিল। এটি বিরল ঘটনা।
এই সুবিধার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারে। তবে বাস্তবে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো সুদ নিতে বা দিতে পারে না। তারা আমানত বিনিয়োগ থেকে পাওয়া ‘মুনাফা’ ভাগ করে। অনিয়মসহ নানা কারণে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল থাকলেও পরিচালকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়ে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।