নিজে ব্যাংকের মালিক ও চেয়ারম্যান। আবার বড় ব্যবসায়ীও। নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ বহু বছর ধরেই দখলে রেখেছেন। একইভাবে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান পদও তার দখলে। ব্যাংক ব্যবহার করেই ব্যবসা বড় করেছেন। আর গত ১৬ বছর ধরে বিএবির চেয়ারম্যান পদ দখলে রেখে সরকারে প্রভাব খাটাচ্ছেন, সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। ব্যাংকের স্বার্থের চেয়ে সবসময়ই ব্যবসায়ীদের স্বার্থকেই বড় করে দেখেছেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময়েও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে অনৈতিক সুবিধা চেয়েছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। নীতির বাইরে গিয়ে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা চেয়ে গত ৩১ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের কাছে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের সময় ছয় মাস বাড়ানোর আবেদন জানান। এ ছাড়া পুনঃতফসিল করা মেয়াদি ঋণ ও চলতি মূলধন ঋণের কিস্তি পরিশোধ তিন মাস পেছানোর দাবিও জানিয়েছেন তিনি। ব্যবসায়ীদের জন্য এমন সুবিধা তিনি চেয়েছেন ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির পক্ষ থেকে।
এর আগে বিএবি কিংবা ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সুবিধা চাইলেই তা সহজেই অনুমোদন দিয়ে দিতেন সদ্য পদত্যাগ করা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনও সেই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নজরুল ইসলাম মজুমদারের দেওয়া সর্বশেষ প্রস্তাবেও মৌখিকভাবে সায় দিয়েছিলেন সাবেক এই গভর্নর। তবে সরকার পতনের কারণে তা আর বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি তিনি।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, বিএবি এই ধরনের আবেদন কিছুতেই করতে পারে না। তাদের ব্যাংকের স্বার্থ, ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থ, শেয়ার হোল্ডারদের স্বার্থের বাইরে ব্যবসায়িক গ্রুপ বা কাউকে সুবিধা দিতে বলার কোনো এখতিয়ার নেই। এগুলো নীতিনৈতিকতার বিষয়। এর আগেও তারা ব্যাংক কোম্পানি আইনের নীতি পরিবর্তন করিয়েছিল। এসব অনৈতিক।
২০০৮ সাল থেকে ১৬ বছর ধরে বিএবির চেয়ারম্যান পদ দখলে রেখেছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। তার সময়ে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা বেড়েছে। তবে আদালতে আটকা ও অবলোপনসহ ব্যাংকব্যবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ চার লাখ কোটি টাকারও বেশি বলে খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বিএবির চেয়ারম্যান পদে থেকে তিনি অন্যান্য ব্যাংক মালিকদের জোর করে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কোটি কোটি টাকা দান করতে বাধ্য করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নজরুল ইসলাম মজুমদার ব্যাংকের চেয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থের প্রতি মনোযোগী হওয়ায় দেশের ব্যাংকিং খাত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ ঋণ পরিশোধ না করায় এবং বারবার পুনঃতফসিল করায় অনেক ব্যাংক খেলাপির উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাচ্ছে।
তবে নতুন গভর্নর দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় আরও বিপাকে পড়েছে ঋণের নামে অর্থ লুট হওয়া ব্যাংকগুলো। দীর্ঘদিন ধরে বিএবি চেয়ারম্যানের নিজের ব্যাংকই রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ নজরদারিতে। ঋণ পুনরুদ্ধার নিয়ে কখনোই কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি নজরুল ইসলামকে। কারণ ঋণের সুবিধাভোগী তিনি নিজেও।
অনাদায়ী ঋণ আদায় এক্সিট-সংক্রান্ত সার্কুলার প্রসঙ্গে বিএবির চিঠিতে বলা হয়, ঋণগ্রহীতার ব্যবসা, শিল্প বা প্রকল্প কখনো কখনো বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে বন্ধ হয়ে যায় অথবা লোকসান দিয়ে পরিচালিত হয়। ফলে ওই ঋণসমূহ বিরূপমানে শ্রেণিকৃত হয়ে যায়। এ ধরনের ঋণসমূহ আদায়ের লক্ষ্যে বর্তমানে এক্সিট সুবিধা প্রাপ্তির গ্রাহককে ঋণস্থিতির ন্যূনতম ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নগদে পরিশোধপূর্বক আবেদন করতে হয়। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের ডাউন পেমেন্ট দেওয়া কষ্টসাধ্য হওয়ায় ব্যাংকের পক্ষে ঋণ আদায়ের হার কমে যাবে। এমতাবস্থায় ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই ডাউন পেমেন্টের নীতিমালা শিথিল করার অনুরোধ জানায় বিএবি।
একটি মেয়াদি ঋণের অপরিশোধিত কিস্তি পরিশোধের জন্য নির্ধারিত তারিখ থেকে পরবর্তী ছয় মাস পর মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। পরে ২০২৪ সালের আরেকটি সার্কুলার অনুযায়ী ছয় মাসের পরিবর্তে আগামী ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিন মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর এবং ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ থেকে নির্ধারিত দিন থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য করা হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় তা ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ কার্যকরের দাবি জানায় বিএবি। এ ছাড়া সব অশ্রেণিকৃত এবং পুনঃতফসিলিকৃত মেয়াদি ঋণের কিস্তি ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিলম্বিত হিসেবে বিবেচনা করার পাশাপাশি সব ধরনের অশ্রেণিকৃত চলমান ও তলবি ঋণ, যেসবের মেয়াদোত্তীর্ণের সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আছে, সেসব ঋণের মেয়াদ ন্যূনতম তিন মাস বাড়াতে হবে বলে জানান নজরুল ইসলাম।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রপ্তানিমুখী শিল্পের রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ওই শিল্পসমূহ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসাগুলোকে আগামী তিন মাসের জন্য পূর্বনির্ধারিত হারে নগদ সহায়তা বহাল রাখার জন্য অনুরোধও জানায় বিএবি।
এ বিষয়ে বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, আমরা গত ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকে যে আবেদন করেছিলাম তারপরে তো ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এটার আর কোনো ফিডব্যাক আমরা পাইনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, নজরুল ইসলাম মজুমদার একজন ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে কীভাবে ব্যাংকের স্বার্থবিরোধী আবদার নিয়ে আসতে পারেন? ব্যবসায়ীদের সুবিধা দরকার হলে তারা আসবে। এই ধরনের সুযোগ-সুবিধা চাওয়ার কোনো অধিকার তার নেই। শুধু তিনিই নন। অনেকেই বিভিন্ন সময় নানা অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন আবদুর রউফ তালুকদারের কাছ থেকে। অনেককে সুবিধা দেওয়ার জন্য নীতি পরিবর্তনেরও ঘটনা অহরহ ঘটেছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।