ডেস্ক রিপোর্ট: দেশের পুঁজিবাজারে প্রথমবারের মতো ২০০৫ সালে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় সামিট পাওয়ার লিমিটেড। এরপর একে একে এ খাতের আরো আটটি কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসে।
সরকারের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী আয়ের নিশ্চয়তা থাকায় পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা বিদ্যুৎ খাতের শেয়ারে বিনিয়োগে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বাজারে কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরও বাড়তে থাকে।
তবে টাকার অবমূল্যায়ন ও বিদ্যুতের দাম পরিশোধে বিলম্বের কারণে এ খাতের কোম্পানিগুলো এখন লোকসানের পাশাপাশি নগদ অর্থের সংকটে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলোয় বিনিয়োগকারীদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়ছে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
দেশের পুঁজিবাজারে এখন বিদ্যুৎ খাতের নয়টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। সর্বশেষ চলতি ২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথমার্ধে লোকসান গুনতে হয়েছে খাতটির চার কোম্পানিকে। হিসাব বছরের প্রথমার্ধে বাকি পাঁচটি মুনাফা করলেও এর পরিমাণ ছিল আগের বছরের তুলনায় কম।
বারাকা পাওয়ার লিমিটেড চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে ৮ কোটি ৮ লাখ টাকা কর-পরবর্তী নিট লোকসান করেছে। আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির ৩৭ কোটি ৮ লাখ টাকা নিট মুনাফা হয়েছিল। একইভাবে বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেডের প্রথমার্ধে নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ৪৫ কোটি ১২ লাখ টাকায়। আগের বছরের একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা ছিল ৫৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
ডরিন পাওয়ার জেনারেশনস অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেডের চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে ১৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে নিট মুনাফা ছিল ৭৯ কোটি ৬ লাখ টাকা।
এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের নিট মুনাফা চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে ৬ কোটি ৫ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে নিট মুনাফা ছিল ১৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
জিবিবি পাওয়ার লিমিটেড চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে ৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছে। আগের বছরের একই সময়ে নিট মুনাফা ছিল ৬ কোটি ৭ লাখ টাকা।
খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে ৭৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা নিট লোকসান গুনেছে। আগের বছরের একই সময়ে ৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকা নিট লোকসান ছিল।
শাহজীবাজার পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে ২২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা কর-পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছে। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে ৫৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা নিট মুনাফা হয়েছিল।
সামিট পাওয়ার লিমিটেড চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে ৩০৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছে। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে নিট মুনাফা ছিল ৩৪৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নিট মুনাফা চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে ৫৮৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে নিট মুনাফা ছিল ৬৯৯ কোটি ৯ লাখ টাকা।
বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, গত বছরের মে মাসের পর থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে আইপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিল বিলম্বিত হতে শুরু করে। একপর্যায়ে বকেয়া বিল জমতে জমতে সাড়ে ছয় মাসের জমে যায়, যার পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকা। যদিও এখন এর পরিমাণ কিছু কমে ১৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিপুল পরিমাণ এ অর্থ বকেয়া থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন চলতি মূলধন সংকটে পড়েছে। এতে কোম্পানিগুলোর নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণেও অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বড় অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। ডলারের প্রাপ্যতা সংকটের প্রভাবে এলসি খুলতে পারছে না অনেকেই। তার ওপর দেশের বেসরকারি খাতের নেয়া বিদেশী ঋণের বড় অংশই বিদ্যুৎ খাতের।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়েও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছেন খাতটির উদ্যোক্তারা। সব মিলিয়ে চতুর্মুখী এ চাপের কারণে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের মধুচন্দ্রিমার সময় শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, বিনিয়োগের নিরাপত্তার স্বার্থে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ নির্ধারিত থাকার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। নির্দিষ্ট মেয়াদের কারণে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো ইকুইটি হিসেবে তালিকাভুক্ত না হয়ে বন্ড হিসেবে এলে ভালো হতো কিনা সেটি আলোচনার দাবি রাখে। তবে মেয়াদ শেষে যে সম্ভাব্য পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে সেটি সব শ্রেণীর বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল।
সরকারের সঙ্গে করা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুসারে বিদ্যুৎ অবিক্রীত থাকলেও উদ্যোক্তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। এতে কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের বিপরীতে রিটার্নের বিষয়ে এক প্রকার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। আর এ নিশ্চয়তার বিষয়টিই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানির শেয়ারকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
খুলনা পাওয়ার ২০১০ সালে সরাসরি পদ্ধতিতে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে বড় অংকের অর্থ উত্তোলন করেছিল। অবশ্য এর ১১ বছর পরই কোম্পানিটির তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় কোম্পানিটির ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজেস অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি তাদের মালিকানাধীন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩৫ শতাংশ শেয়ার দেয় খুলনা পাওয়ারকে। এতে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা কোনো রকমে সচল থাকে।
তালিকাভুক্ত আরেক বিদ্যুৎ কোম্পানি জিবিবি পাওয়ারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ এ বছরের জুনে শেষ হবে। যদিও এ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। কোম্পানিটির উদ্যোক্তারা বিদ্যুতের পরিবর্তে চায়ের ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন।
২০২১ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন এরই মধ্যে তাদের ঠাকুরগাঁওয়ের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পুরো শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সব মিলিয়ে তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
খুলনা পাওয়ারের কোম্পানি সচিব মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, আমরা একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। যদিও এখনো এর অনুমোদন পাইনি। বিদ্যমান বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি নতুন কেন্দ্র স্থাপন কিংবা ব্যবসার সুযোগ খোঁজা হচ্ছে।
অবশ্য বর্তমানে যে বাস্তবতা তাতে দ্রুত কোম্পানির আর্থিক পারফরম্যান্স আগের অবস্থানে চলে যাবে এমন নয়। তবে কোম্পানির পর্ষদ চেষ্টা করছে। আশা করছি সামনে কোম্পানির আয় বাড়বে—এমন ব্যবসা শুরু করা সম্ভব হবে।
মেয়াদান্তে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজন পড়লে মেয়াদ বাড়ানো হলেও তা করা হয় ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্টের’ ভিত্তিতে। আগের মতো নিশ্চিত আয়ের সুযোগ পায় না বর্ধিত মেয়াদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। আবার এ বিদ্যুৎ কেনা হয় শুধু প্রয়োজনের মুহূর্তে।
সামিট পাওয়ারের আশুলিয়ার ৩৩ দশমিক ৭৫ মেগাওয়াট, নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জের ১০২ মেগাওয়াট, চান্দিনার ১৩ দশমিক ৫ মেগাওয়াট ও মাধবদীর ২৪ দশমিক ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ গত বছর নবায়ন করে সরকার।
ইউনাইটেড পাওয়ারের আশুগঞ্জের ৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদও গত বছর বাড়ানো হয়। ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিকানাধীন প্রতিটি ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
খুলনা পাওয়ারের ১১৫ মেগাওয়াট ও ৪০ মেগাওয়াট সক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয় গত বছর। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আয় ও মুনাফা আগের তুলনায় কমে এসেছে।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে ডেট ও ইকুইটি দুভাবেই অর্থ সংগ্রহ করেন। এ দুই ধরনের সংমিশ্রণ থাকাই ভালো। এতে ইকুইটিধারীদের রিটার্নের পরিমাণ বেড়ে যায়। কারণ ডেটের ক্ষেত্রে রিটার্নের বিষয়টি নির্দিষ্ট করা থাকে।
অন্যদিকে ইকুইটির ক্ষেত্রে আয় ও মুনাফা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রিটার্নও বেড়ে যায়। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদ্যুৎ খাতের ব্যবসায় যে প্রভাব পড়েছে সেটি চলতি হিসাব বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকেই প্রশমিত হতে শুরু করেছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকেই এর প্রভাব থাকবে না।
পাশাপাশি দেশে বিদ্যুতের চাহিদা থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতেই হবে। এতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ বিক্রির মাধ্যমে আয় ও মুনাফা অর্জন করতে পারবে। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগকারীরাও লভ্যাংশ পাবেন বলে আশা করি।
© দৈনিক স্টক বাংলাদেশ- ২০২৩
বার্তা ও সম্পাদকীয় কার্যালয়: ৯৯, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫
ফোন: +৮৮০ ১৭৯৭-৬১১৯৬১, +৮৮০ ৯৬৩৮ ৯৩৫৭৩৬
ইমেইল: info@dailystockbd.com (যোগাযোগের সর্বোত্তম মাধ্যম মুঠোফোন)