সিনিয়র রিপোর্টার: রিং শাইন টেক্সটাইলকে অধিগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে গত ১৭ মে ইউনিয়ন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু পরে ইউনিয়ন গ্রুপ প্রতিষ্ঠানটি অধিগ্রহণ করার প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়ায়।
এরপর রিং শাইন টেক্সটাইল অধিগ্রহণ করার আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে ওয়াইজ স্টার টেক্সটাইল মিলস।
প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কুইন সাউথ টেক্সটাইল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওয়াং জেমির ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। রিং শাইন টেক্সটাইলের দায়িত্ব নিতে ওয়াইজ স্টার টেক্সটাইল বিএসইসি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), রিং শাইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ব্যাংক, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষসহ (বেপজা) সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করে।
রিং শাইন টেক্সটাইল অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পেলেও বেপজার পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বেপজার সহযোগিতা পেতে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ওয়াইজ স্টার টেক্সটাইল।
বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ওয়াইজ স্টার জানিয়েছে, বিএসইসির অধিগ্রহণের অনুমতি ও সহায়তা পেলে প্রথম ৬ মাসের মধ্যে রিং শাইন টেক্সটাইলের সব মেশিন রিমডেলিং ও মেরামত করা হবে।
আর ২০২৩ সালের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে প্রতি মাসে ৬ থেকে ৮ মিলিয়ন (৬০-৮০ লাখ টাকা) ব্যবসা থেকে আয় করা সম্ভব হবে। এতে কোম্পানিটির প্রতি হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করে ওয়াইজ স্টার টেক্সটাইল।
প্রতিষ্ঠানটি চিঠিতে জানিয়েছে, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের কারণে মন্দা চলছে। ফলে গার্মেন্টসের অর্ডার কমেছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ডলারের দাম বাড়ার কারণে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদরাও উদ্বিগ্ন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেপজা, সুদের সঙ্গে ব্যাংকের বকেয়া, কাস্টমস বকেয়া এবং অন্যান্য সব মিলিয়ে রিং শাইনের মোট দায় প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। যেখানে কোম্পানিটির সম্পদ তার তুলনায় কম। কারখানাটিকে প্রতি মাসে প্রায় ১০-১২ মিলিয়ন সক্ষমতার সর্বোত্তম উৎপাদনের জন্য আরও ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে।
এদিকে, স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিএসইসি ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সফলভাবে চুক্তি করার জন্য সহযোগিতা করছে। বাংলাদেশের বস্ত্র ও গার্মেন্টস শিল্পকে সহায়তা করতে সরকার আগ্রহী। ফলে টেকসই এবং অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করার জন্য শর্তাবলির মাধ্যমে এ শিল্পের অনুকূলে ব্যাংক ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি সার্কুলার জারি করেছে, যাতে ব্যাংক ন্যূনতম ডাউন পেমেন্টসহ ৭ বছর পর্যন্ত ঋণ পুনর্র্নিধারণ করতে পারে৷
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, এরই পরিপ্রেক্ষিতে সব ব্যাংক যুক্তিসংগতভাবে সুদ মওকুফ করতে এগিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক সার্কুলার অনুযায়ী ঋণ পুনর্র্নিধারণ কোম্পানিগুলোকে সাহায্য করছে৷ এ ছাড়া রিং শাইনের দায় পর্যালোচনার জন্য এনবিআরের (কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট) সঙ্গে ওয়াইজ স্টার কাজ করেছে।
কিন্তু বেপজা বিভিন্ন সারচার্জ মওকুফ করে কোম্পানিটির কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করার জন্য কোনো অনুকূল পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ বিষয়টি ওয়াইজ স্টারের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে না। বেপজার প্রতি মাসে ২ শতাংশ সারচার্জ খুব বেশি, যা প্রতি মাসে প্রায় ১ দশমিক ৫০ লাখ ডলার আসে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ পরিমাণ সারচার্জ কাটা ঠিক নয়।
এদিকে রিং শাইনের সঙ্গে সাম্প্রতিক বেপজার বৈঠকে বলা হয়, ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দুই মাসের মধ্যে দিতে হবে। কিন্তু ওয়াইজ স্টার ডাউন পেমেন্টের কিছু অংশ এখন এবং ৫ বছরের কিস্তিতে বকেয়া টাকা সমন্বয় করতে প্রস্তুত।
তাই বিষয়টি নিয়ে বেপজা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য বিএসইসির হস্তক্ষেপ কামনা করছি। কারণ আমরা রিং শাইনের কারখানায় কাজ শুরু করতে প্রস্তুত আছি। আশা করছি, রিং শাইনের সঙ্গে ওয়াইজ স্টারের এমওইউ স্বাক্ষর করতে সমর্থন দেবে বিএসইসি।
রিং শাইনকে অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ওয়াইজ স্টার যেসব সুবিধা চেয়েছে সেগুলো হলো—রিং শাইনকে সর্বশেষ ব্যালান্স শিট প্রকাশ করতে হবে এবং গত ৩ বছরের অনুষ্ঠিত না হওয়া বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) সম্পন্ন করতে হবে। ইউটিলিটি, জমি ভাড়া, সুদ ও জরিমানা বাবদ বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) থেকে সর্বমোট ৭০ কোটি টাকা মওকুফ করতে হবে।
বন্ড, কাস্টমস ও আয়কর রিটার্ন অফিস পরিচালনার সহায়তা। বন্ড, শুল্ক ও আয়কর রিটার্ন পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রয়োজন। স্থানীয় সরবরাহকারী বা বিক্রেতাদের পাওনা পরিশোধ করতে হবে। শ্রমিকের দায় রয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা, যা পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের দায় মুক্তি এবং মেশিন মেরামত ও রিমডেলিংয়ের জন্য প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অবশিষ্ট তহবিল ব্যবহারের অনুমোদন দিতে হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১২ মার্চ বিএসইসি রিং শাইন টেক্সটাইলসকে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তোলার অনুমোদন দেওয়া হয়। কোম্পানিটি যন্ত্রপাতি ও কলকবজা ক্রয়, ঋণ পরিশোধ ও আইপিও খরচ খাতে ব্যয় করতে শেয়ারবাজারে ১৫ কোটি সাধারণ শেয়ার ছেড়ে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এরপর ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।
তবে লোকসানের কারণে এক বছরের মধ্যে ২০২০ সালের শেষদিকে কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরে কোম্পানিকে উৎপাদনে ফেরাতে কয়েক দফায় পদক্ষেপ নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। প্রথম দফায় কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠন করে। দ্বিতীয় দফায় আইপিওর ফান্ড ব্যবহারে অনুমোদন এবং ভুয়া প্লেসমেন্ট শেয়ার বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
নতুন পরিচালনা পর্ষদে তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ থাকার পর রিং শাইন টেক্সটাইলস গত বছরের ১৩ জুন থেকে ২৫ শতাংশ উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৫০০ কোটি ৩১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সে হিসেবে কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ৫০ কোটি ৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৩টি।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকের হাতে ২১ দশমিক ৩২ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।