সকল মেনু

পণ্য রপ্তানির আড়ালে বেক্সিমকোর অর্থ পাচার

বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি করেছেন পিতা। এই পণ্যের কাঁচামাল কিনতে রিজার্ভ থেকে ডলার ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই পণ্য দুবাইয়ে বসে কিনেছে পুত্রের প্রতিষ্ঠান। নির্ধারিত সময়ে সেই অর্থ দেশে আসেনি। এভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ তিনটি দেশে আটকে গেছে প্রায় ৮ কোটি ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৯৫৭ কোটি টাকা।

রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের এই আয়োজন সম্পন্ন করেছে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং তাঁর ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমানের দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর আর গ্লোবাল।

বেক্সিমকো গ্রুপের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে গত ১২ বছরে তিনটি দেশে পোশাক রপ্তানি দেখিয়ে এ টাকা পাচার করেছে বলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এই ঘটনায় গ্রুপটির মালিক-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে এই অর্থ পাচার করেছে বেক্সিমকো গ্রুপ।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ঋণগ্রহীতা বেক্সিমকো গ্রুপ। ব্যাংকটির বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে।

জনতা ব্যাংকের রপ্তানি বিভাগ এক প্রত্যয়নপত্রে সিআইডিকে জানিয়েছে, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট প্রায় ৮ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই টাকা দেশে আসেনি বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যয়নপত্রের বিষয়টি জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল জব্বার নিশ্চিত করেছেন।

মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিউল ইসলাম বলেন, অর্থ পাচারের ঘটনায় বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। ১৪ আগস্ট ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ১ সেপ্টেম্বর বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের বিষয়টি অনুসন্ধান শুরু করে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। ২২ আগস্ট সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

কত টাকা পাচার

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেক্সিমকোর ১৭টি প্রতিষ্ঠান দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যে পোশাক রপ্তানি করেছে। তদন্তে দেখা গেছে, দুবাইয়ের যে প্রতিষ্ঠানে বেক্সিমকো পোশাক রপ্তানি দেখিয়েছে, সেটি সালমান এফ রহমানের পরিবারের। কেবল পোশাক রপ্তানির আড়ালে প্রায় ৮ কোটি মার্কিন ডলার পাচার করেছে বেক্সিমকো গ্রুপ, যা বর্তমান বাজারমূল্যে ৯৫৭ কোটি টাকার সমান।

বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান তাঁর ভাই সালমান এফ রহমান। দুবাইয়ে আর আর গ্লোবালের মূল প্রতিষ্ঠান আর আর হোল্ডিংসের প্রতিষ্ঠাতা সোহেল রহমানের ছেলে আহমেদ শাহরিয়ার রহমান ও সালমান এফ রহমানের ছেলে শায়ান এফ রহমান। দুবাইয়ের আল গারহৌদ এলাকার জালফা বিল্ডিংয়ের ঠিকানায় আর আর হোল্ডিংসের নিবন্ধন হয়। ৫ আগস্টের আগে আর আর হোল্ডিংসের ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটির নানা ব্যবসার ও প্রতিষ্ঠাতাদের তথ্য দেওয়া ছিল। পরে প্রতিষ্ঠাতাসহ কিছু তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়। প্রতিষ্ঠানটি তেল-গ্যাস, পোশাকসহ নানা খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বলে সেখানে উল্লেখ আছে।

সিআইডি সূত্র জানায়, পোশাক রপ্তানি ছাড়াও বেক্সিমকো গ্রুপ গত ১৫ বছরে জনতা ব্যাংকসহ ৭টি ব্যাংক থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। এ ছাড়া নামে-বেনামে আইএফআইসি, ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক থেকেও একই কায়দায় ঋণ নিয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি গত তিন বছরে বন্ডের নামে বাজার থেকে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছে। এ ছাড়া আরও ২০ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার তথ্য পেয়েছে সিআইডি।

সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, বেক্সিমকো গ্রুপ সৌদি আরবের দাম্মামে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল গড়ে তুলেছে। যার পুরো অর্থ দেশ থেকে নেওয়া হয়েছে। গ্রুপটির বিরুদ্ধে পোশাক রপ্তানির বাইরে বাণিজ্যের আড়ালে ১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে সিআইডি। এ নিয়ে মঙ্গলবার বেক্সিমকো গ্রুপের বক্তব্য জানতে গ্রুপটির জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান ইমপ্যাক্ট পিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বক্তব্য দিতে পারেনি।

বেক্সিমকোয় উদার জনতা

জনতা ব্যাংকের বেশ পুরোনো গ্রাহক বেক্সিমকো গ্রুপ। গ্রুপটি ১৯৭৮ সালে জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে। ১৯৯৮ সালে গ্রুপটির পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন সালমান এফ রহমান। এরপর বেক্সিমকোর টেক্সটাইল, এলপিজি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। ২০১৮ সালে জনতা ব্যাংক বেক্সিমকোর প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগ্রাসী অর্থায়ন করে। ব্যাংকটির মতিঝিলের স্থানীয় কার্যালয় শাখা থেকে এই অর্থায়ন করা হয়, তখন শাখাটির ব্যবস্থাপক ছিলেন মিজানুর রহমান। তিনি এখন প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত।

জনতা ব্যাংক একটি গ্রুপকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে, দিয়েছে তার প্রায় ১৬ গুণ বেশি। যার পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। বেক্সিমকোর ঋণের ১৮ হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে। ফলে জনতা ব্যাংকের ঋণের ৫০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এতে ব্যাংকটি তারল্যসংকটে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মে পণ্য রপ্তানি হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে রপ্তানি আয় দেশে আনতে হয়। আর তা না হলে অর্থ পাচার আইনে ওই রপ্তানিকারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে বেক্সিমকোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ১২ বছর ধরে পণ্য রপ্তানি করে সেই আয় দেশে না আনা বড় ধরনের অনিয়ম ও অপরাধ। এর পেছনে অর্থ পাচারের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো কারণ নেই। বিদেশ থেকে রপ্তানির অর্থ না আসার পরও জনতা ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটিকে যেভাবে অর্থ দিয়ে গেছে, সেটি একটি অপরাধ। এই অপরাধের সঙ্গে বেক্সিমকো ও ব্যাংকের যাঁরা যাঁরা জড়িত, তাঁদের শাস্তি হওয়া উচিত। প্রয়োজনে বেক্সিমকোর সম্পদ বিক্রি করে হলেও অর্থ আদায়ে কার্যকর সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top