গ্রাহকদের আর্থিক অবস্থার অবনতি, সচেতনতার অভাব ও এজেন্টরা বিমা বিক্রির সময় সঠিকভাবে এর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা না করার প্রবণতাসহ অন্যান্য কারণে গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে ২৬ লাখেরও বেশি বিমা পলিসি বাতিল হয়ে গেছে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্য অনুসারে, ২০০৯ সালে দেশে মোট বিমা পলিসির সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি ১২ লাখ। ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ৮৫ লাখ ৮৮ হাজার।
গ্রাহকরা সময় মতো বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে না পারলে তার বিমা কভারেজ (পলিসি) তামাদি বা বাতিল হয়ে যায়। বাংলাদেশে প্রায় ৫০ শতাংশ জীবন বিমা পলিসি গ্রহীতা প্রথম বছরের পর প্রিমিয়াম পরিশোধ করেন না, তথ্য আইডিআরের।
দেশে বিমা পেশাদারদের প্রশিক্ষণ প্রদানকারী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স একাডেমির পরিচালক এস এম ইব্রাহিম হোসেন জানান, ভারতে তামাদি বা বিমা পলিসি বন্ধ হওয়ার হার ১০ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী স্ট্যান্ডার্ড হার হলো ৯৬ থেকে ৯৮ শতাংশ বিমা পলিসি চালু থাকা।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারীর মতে, তামাদির হার এত বেশি হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গ্রাহকদের সামর্থ্যের তুলনায় উচ্চ মূল্যের বিমা পরিকল্পনা কেনা ও সম্ভাব্য গ্রাহকদের বিমা সম্পর্কে সার্বিক তথ্য না দেওয়া।
তিনি বলেন, অনেক সময় এজেন্টরা পলিসি বিক্রির সময় এর নিয়মগুলো তার সম্ভাব্য গ্রাহককে বলেন না। এজেন্টরা অনেক সময় এমন বিমাও বিক্রি করেন, যেটা গ্রাহকের প্রয়োজন নাও হতে পারে। এমনকি ওই বিমা চালিয়ে যাওয়ার আর্থিক সক্ষমতা গ্রাহকের নাও থাকতে পারে। বিমা পলিসি বন্ধ হওয়ার আরও কিছু কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো অনেক এজেন্ট গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের টাকা আত্মসাৎ করেন।
ইব্রাহিম হোসেনের মতে, প্রিমিয়াম না দেওয়া এবং গ্রাহকের আয় কমে যাওয়া বিমা বাতিলে ভূমিকা রাখে। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকরা অন্য কারো কাছে প্রিমিয়ামের টাকা দেন, যিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা জমা করেন না বা টাকাই জমা দেন না।
তিনি জানান, অনেক সময় এজেন্টরাও পেশা পরিবর্তন করেন এবং বিমাকারীরা শাখা বন্ধ করে দেন। বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও গ্রাহকদের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে।
আইডিআরএর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিছু বিমা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা এজেন্টদের প্রভাবিত করেন যেন পলিসি বন্ধ করা হয়। প্রথম বছরের শেষে যদি পলিসি চালু রাখা না হয়, তাহলে বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর বিমা দাবি পরিশোধ করতে হয় না।
দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক জীবন বিমাকারী প্রতিষ্ঠান মেটলাইফ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলা আহমদ বলেন, পলিসি বাতিল হওয়া গ্রাহক ও বিমা প্রতিষ্ঠান উভয়ের জন্যই খারাপ।
বিমা বাতিল হওয়া মানে গ্রাহক অপ্রত্যাশিত ঘটনার ঝুঁকিতে থাকবেন এবং বিমা প্রতিষ্ঠান রাজস্ব হারাবে, যার ফলে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও গ্রাহকের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রায়শই নিয়মিত প্রিমিয়াম দেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে পলিসি বাতিল হয়ে যায়।
আলা আহমদ বলেন, গ্রাহকদের বিমার মেয়াদ জুড়ে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকতে সহায়তা করার উদ্যোগ নিয়েছে মেটলাইফ। এর মধ্যে আছে গ্রাহকদের বিক্রয়োত্তর প্রোঅ্যাকটিভ ব্রিফিং কল, এসএমএস, ডিজিটাল প্রিমিয়াম পেমেন্ট চ্যানেল ও প্রশিক্ষিত এজেন্ট নিয়োগ।
প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জালালুল আজিম জানান, তিনি ২০১৩ সালে এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পর দেখেছেন প্রথম বছরের পর প্রায় ২০ শতাংশ পলিসি টিকে থাকত। এটি এখন ৪৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
তিনি বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের জন্য প্রয়োজনীয় বিমা বিক্রির দিকে মনোনিবেশ করছে। এর ফলে পলিসি বন্ধের হার কমেছে। প্রিমিয়াম সংগ্রহে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার গ্রাহকদের বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্স তিন বছরের মধ্যে পলিসির ধারাবাহিকতার হার ৬০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও বিমা বিভাগের অধ্যাপক মো. মঈন উদ্দিন মনে করেন, পলিসি বন্ধ হওয়ার এই উচ্চহার বিমা খাত সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণার প্রমাণ দেয়। এটা বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় ব্যর্থতা। এজেন্টরা প্রথম বছরে প্রদত্ত প্রিমিয়ামের ওপর বড় অংকের কমিশন পান। তাই তারা যতটা সম্ভব বড় অংকের বিমা পলিসি বিক্রির চেষ্টা করেন।
বর্তমানে এজেন্টরা একটি পলিসির জন্য প্রথম বছরের প্রিমিয়ামের ওপর প্রায় ৩৫ শতাংশ, দ্বিতীয় বছরে ১০ শতাংশ ও পরবর্তী বছরগুলোর জন্য ৫ শতাংশ করে কমিশন পান। কমিশনের এই হার সংশোধন করা উচিত, যাতে এজেন্টরা পলিসি নবায়নের দিকে আরও মনোযোগী হন।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান জয়নুল বারী বলেন, এক মাসের মধ্যে কমিশন রেট সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইডিআরএ। ২০২৩ সালে পলিসি বন্ধে উচ্চ হার রয়েছে এমন ১০ প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে, তারা যেন নবায়নকৃত পলিসির সংখ্যা ৬০ শতাংশে উন্নীত করে।
বারী আরও বলেন, আমরা এখনো প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন পাইনি। এটি পাওয়ার পর আমরা বুঝতে পারব যে তারা কতটা অগ্রগতি করেছে। নীতিমালা মেনে না চলায় কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করার পাশাপাশি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।