সকল মেনু

২০টি মন্ত্রণালয়ের ১৩ বিষয়ে সমন্বয় না হওয়ায় অনগ্রসর পর্যটন শিল্প

শাহীনুর ইসলাম : ২০টি মন্ত্রণালয় ও ৬২টি সরকারি প্রতিষ্ঠান পর্যটনের সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ের আরও কিছু প্রতিষ্ঠান পর্যটন শিল্পের বিকাশে কাজ করছে। ২০১০ সালে ট্যুরিজম বোর্ড গঠন এবং ২০১৩ সালে টুরিস্ট পুলিশ গঠন হলেও মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।

২০১৩ সালে টুরিস্ট পুলিশ গঠন হওয়ার আগে সরকারে আইনি কাঠামো তৈরি হয় এবং সংশ্লিষ্ট ২০টি মন্ত্রণালয়ের ৬২টি প্রতিষ্ঠানের নথিতে পর্যটন পুলিশের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। যে কারণে আইনগুলোকে সংশোধন করা জরুরি এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ বলে মনে করা হয়।

২০টি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ১৩টি বিষয়ে সমন্বয় না হওয়ায় পর্যটনখাত অনগ্রসর হয়ে পড়ছে বলে গবেষণা প্রতিবদেনে প্রকাশ করা হয়েছে। রাজধানীর গুলশানের স্পেক্ট্রা কনভেশন সেন্টারে বুধবার (২৫ মে) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ সেন্টার ফর এ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস)।

‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে এবং ঐতিহ্য’র প্রচার ও প্রসারে ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা বা রোল অব ট্যুরিস্ট পুলিশ টু এনহান্স ইকোনমিক প্রস্পেক্ট অ্যান্ড শোকেজিং হেরিটেজ অব বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।

বিসিএএসের চেয়ারম্যান খন্দকার মঈনউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ডিপার্টমেন্টের সুপারনিউমেরারী অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ড. খন্দকার বজলুল হক।

কর্মশালায় বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রাক্তন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক আরিফ উদ্দিন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রতিনিধি এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

পর্যটন শিল্পের বিকাশে যে আইনগুলোকে সংশোধন করা জরুরি এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ বলে মনে করা হয়। তা হলো— পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সুন্দরবন ভ্রমণ নির্দেশিকা, জাতীয় জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭, পরিবেশ, বাংলাদেশ পরিবেশ আইন ১৯৯৫, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য নিরাপত্তা আইন, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সদস্য নির্বাচনের মানদণ্ড, বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন ২০১৬, পর্যটন মাস্টারপ্ল্যান, সামুদ্রিক পর্যটন নীতি ২০২২, পর্যটন বোর্ড আইন ২০১০, জাতীয় পর্যটন নীতি ২০১০, জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮, পরিবেশ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও সুরক্ষা আইন -২০১২, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল কর্ম পরিকল্পনা ২০১০ এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান।

গবেষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন গবেষণার সমন্বয়কারী এবং বিসিএএস জ্যেষ্ঠ গবেষক মনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশের অনেকগুলো মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ গঠন করা হয়। পর্যটন শিল্পে ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান কার্যালয়ের সহায়তায় বিসিএএস ৬ মাস দেশের ছয়টি পর্যটন এলাকায় গিয়ে গবেষণা করে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, বান্দরবান, কক্সবাজার, কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন, বাগেরহাট এবং বাগেরহাটের মোংলায় গবেষণা প্রকল্পটি পরিচালনা করা হয়।

গবেষণার মূলত তিনটি উদ্দেশ্য; অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ট্যুরিজম এবং ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যগুলোর প্রসারে ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা ও ট্যুরিজমের ভ্যালু চেইনে ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা চিহ্নিত করা।

গবেষণার জন্য প্রায় ৮০০ পর্যটকের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র জরিপের মাধ্যমে তথ্য নেয়া হয়েছে। এছাড়া পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার, কেস স্টাডিজের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ এবং স্থানীয় পর্যায়ে গবেষণা ফলাফল সহভাগিতার মাধ্যমে গবেষণাটি সমৃদ্ধ করা হয়।

জাতীয় বিশ্বদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান ড. মো. আনোয়ার হোসেন ভুঁইয়া গবেষণা সেই ফলাফল উপস্থাপন করেন।

গবেষণাপত্র উপস্থাপনকালে আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে পর্যটন খাতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি সম্ভাবনাময় খাত। দেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ বছরে পর্যটন স্থানগুলোতে ভ্রমণ করেন। এই খাতের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—পর্যটকদের নিরাপদ আবাসন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

গবেষণায় পর্যটন খাতের সার্বিক উন্নয়নে ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য আরও বৃদ্ধি করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। পরিবেশ সংরক্ষণ, পর্যটন স্থানগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যটন স্থানগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশের উপস্থিতি বৃদ্ধি করা দরকার।

পর্যটকদের জন্য চিকিৎসা সুবিধা উন্নত, খাদ্য ও আবাসিক হোটেল ব্যবস্থাপনার তদরকি করার ক্ষেত্রে ট্যুরিস্ট পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে গবেষণা ফলাফলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশি আচরণ পরিবর্তনে তাদের প্রশিক্ষণ বা নতুন নিয়োগ দিয়ে নমনীয় মেজাজের বা বিনয়ী পুলিশের প্রয়োজনকে গুরুত্ত্ব দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।

৮৬ শতাংশ পর্যটক ট্যুরিস্ট পুলিশের বর্তমান কার্যক্রমকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন বলে গবেষণাপত্রে তুলে আনা হয়েছে।  ট্যুরিস্ট পুলিশের দক্ষতা উন্নয়নে বেশ কিছু সুপারিশের উল্লেখ করা হয়েছে। 

সবচেয়ে চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—২০টি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট ৬২টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ট্যুরিস্ট পুলিশের কর্মপরিধি বাড়ানো দরকার। ২০১৩ সালে ট্যুরিস্ট পুলিশ গঠন হওয়ার আগে সরকারে আইনি কাঠামো হওয়ায় সেখানে পর্যটন পুলিশের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা হয়নি; যা এখন করা জরুরি।

একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যগুলো সম্পর্কে ট্যুরিস্ট পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের বিষয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা; বিদ্যমান নীতি-কৌশলগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা ও দায়িত্ব পালনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা, প্রত্নতত্ত্ব সমুদ্র সৈকত এবং অন্যান্য স্থানে ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রশিক্ষিত উদ্ধারকারী দলের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি দরকার।

বিশেষ অতিথি হিসেবে জাবেদ আহমেদ পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারের গৃহীত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কথা জানান। তিনি বলেন, এই শিল্পের বিকাশে বর্তমান সরকার ২০১০ সালে ট্যুরিজম বোর্ড গঠন এবং ২০১৩ সালে ট্যুরিস্ট পুলিশ গঠন করে।

একইসঙ্গে পর্যটন বিকাশে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় গবেষকদের নিয়ে ‘ট্যুরিস্ট মাস্টার প্ল্যান’ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং চলতি বছরে সেই মাস্টার প্লান শেষ হচ্ছে। পর্যটকদের সঙ্গে পুলিশি আচরণের পরিবর্তে ‘নমনীয় মেজাজ’ বা ‘বিনয়ী পুলিশ’ নিয়োগের প্রতি গুরুত্ব দেন তিনি।

বিআইডব্লিউটিএ যুগ্ম পরিচালক আরিফ উদ্দিন বলেন, নদী কেন্দ্রীক পর্যটন সম্ভাবনাময়। দেশের প্রসিদ্ধ পর্যটন কেন্দ্রগুলো নদীকেন্দ্রিক গড়ে উঠছে। তাই ট্যুরিষ্ট পুলিশ এবং বিআইডব্লিউটিটিএকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজারে বিচ ভরাট করা হয়েছে। রাজধানীর পাশের নদীগুলো তীরবর্তী এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পরে তা ফের দখল হয়। এসব এলাকায় পর্যটন করা সম্ভব এবং বিআইডব্লিউটিটিএ ও টুরিস্ট পুলিশ একসঙ্গে কাজ করলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।

পর্যটন শিল্পের বিকাশে ড. শাহনাজ হুসনে জাহান বলেন, ঐতিহ্যের দিক থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত ধনী দেশ। আমাদের আড়াই হাজার বছরের প্রত্নতত্ব ঐতিহ্য রয়েছে। তাই আমাদের ‘প্রিজারভেশন’ জরুরি এবং মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে আন্তঃসম্পর্ক বাড়ানোর কাজ করতে হবে বা আইনগুলোকে সংশোধন করা জরুরি।

প্রধান অতিথি হিসেবে ড. খন্দকার বজলুল হক বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। এই তিনটি সংরক্ষণ না করলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ সম্ভব নয়। উনয়ন হলেও তা টেকসই উন্নয়ন হবে না। তাই উন্নয়নের সঙ্গে যেহেতু পরিবেশ জড়িত; তাই উন্নয়নের ক্ষেত্রে পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে টেকসই উন্নয়নের দিকে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top