Homeবিশেষ সংবাদদ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বেশিরভাগ বেকারির কারখানা বন্ধ

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বেশিরভাগ বেকারির কারখানা বন্ধ

বিশেষ প্রতিনিধি : দেশের বেকারিগুলোতে একটা সময় হাতে তৈরী পণ্যের চাহিদা থাকলেও দিন দিন তলানিতে যাচ্ছে এই শিল্প। করোনা মহামারির পর থেকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির (বিবিবিওসিপিএস) সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছি। এর মধ্যে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং বড় কোম্পানিগুলোর প্রভাব ছোট উদ্যোক্তাদের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএবিবিএমএ) তথ্য মতে, দেশে প্রায় শতাধিক সক্রিয় বেকারি থাকলেও তালিকাভুক্ত মাত্র ৫২টি। গত এক দশকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বড় ব্যবসায়ীরাও এ খাতে বিনিয়োগ করছে। ফলে বাজারের প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি দখল করছে বেকারি শিল্প।

বিএবিবিএমএ’র সভাপতি মো. আবু বকর বলেন, বাজারে ছোট ও বড় কারখানাগুলো মিলে এ শিল্প ধরে রেখেছে। যার বর্তমান আনুমানিক বাজারমূল্য ৮-৯ হাজার কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালে ৬ হাজার কোটি টাকা ছিলো।

কোম্পানিগুলোর মধ্যে- অলিম্পিক, প্রাণ, পারটেক্স, হক, নাবিস্কো, বঙ্গোজ এবং আকিজ শীর্ষে। এর মধ্যে নতুন করে বসুন্ধরা, মেঘনা, কোহিনূর গ্রুপসহ কিছু কোম্পানিও বাজারে পা রাখছে।

বেকারি মালিকরা জানান, ৫০ কেজি পরিমাণে এক বস্তা গমের দাম এখন ৩০০০-৩২০০ টাকা, যা ছয় মাস আগে ছিল ১৬০০-১৮০০ টাকা, এক বছর আগে ১২০০-১৩০০ টাকা ছিল। ৫০ কেজি চিনির বস্তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৮০০ টাকায়, যা ছয় মাস আগে ছিল ৩০০০-৩১০০ টাকা এবং এক বছর আগে ২৬০০ টাকা।

১৮৫ কেজি পাম তেলের একটি ড্রাম কিনতে ৩৩-৩৫ হাজার টাকা গুনতে হয়, যা ছয় মাস আগে ছিল ২০-২২ হাজার টাকা এবং এক বছর আগে ১৩-১৪ হাজার টাকায় কিনতে পারতাম। ডালডা ১৬ কেজির কার্টুন এখন ৩০০০ টাকায় কিনতে হয়, যা ছয় মাস আগে ২০০০-২১০০ টাকা এবং এক বছর আগে ১২০০-১৩০০ টাকা ছিল।

নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বেকিং কারখানা স্থাপনের জন্য ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন মো. জসিম উদ্দিন। মহামারী চলাকালীন কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। এখন মহামরী কিছুটা শিথিল হলেও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন শুরু করতে পারেনি।

তিনি বলেন, ‘এখন বড় ব্যবসায়ীরা বাজার দখল করে আছে। বর্তমান বাজারে একটি নতুন ব্র্যান্ড তৈরি করা খুবই কঠিন। সেই সাথে বাজারে এখন প্রতিযোগিতা বেড়েছে। নিজেদের উৎপাদিত পণ্য দিয়ে ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে না পারলে, কেউ বাজারে টিকতে পারবে না।’

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের জনপ্রিয় ‘চায়না বেকারি’র সত্ত্বাধিকারী মো. কাওসার বলেন, ‘বাজারে বড় কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করতে না পেরে এবং কাঁচামালের ঊর্ধ্বমুখীর কারণে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি।’

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবরে ‘ন্যাশনাল ব্রেড বেকারি’ ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মো. শাহজাহান। এই কারখানায় প্রায় ৫০ জন শ্রমিক কাজ করে।

মো. শাহজাহান বলেন, কারখানায় যে অর্থ বিনিয়োগ করেছি, কাঁচামালের ঊর্ধ্বগতির কারণে তা এখনো উঠিয়ে আনতে পারিনি। যে হারে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে এভাবে কারখানা চালানো সম্ভব না। তাই বেকারি বন্ধ করে দিয়েছি।

বিবিবিওসিপিএস’র সেক্রেটারি রেজাউল হক রেজা বলেন, ‘বর্তমানে বেকারি পণ্যের প্রধান ভোক্তা নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষ। তাই আমরা যদি বেকারি পণ্যের দাম বাড়াই, তাহলে এটি তাদের উপর বাড়তি বোঝা তৈরি করবে। সেজন্য এখন পর্যন্ত দাম বাড়াইনি। কিন্তু এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে তাই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

পোশাক শ্রমিক নুরুল আফসার বলেন, ‘আমার ৪ সদস্যের পরিবারের জন্য সকালের নাস্তা হিসেবে ৩০ টাকা দামের একটি পাউরুটি হলে হয়। কিন্তু এখন সেই পাউরুটির দাম ৩৫ টাকা হয়েছে। দাম আরও বাড়লে, হয়তো সকালের নাস্তায় আর পাউরুটি খেতে পারব না।’

বিবিবিওসিপিএস’র সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন বলেন, ‘শ্রমিক স্বল্পতা কারখানাগুলোন টিকে থাকার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ন্যূনতম মজুরি দিয়ে পরিবার খরচ মেটানো তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। আর বেকারি মালিকরাও শ্রমিকদের দাবিকৃত মজুরি দিতে পারছেন না। তাই, অনেকে বেকারি ব্যবসা ছেড়ে অন্য দিকে ঝুঁকছে।

বিএবিবিএমএ’র সভাপতি মো. আবু বকর বলেন, ‘আমি কারখানা মালিকদের অনুরোধ করেছি, বাজারে চলমান ‘কৃত্রিম সংকটের’ সময়ে পণ্যের দাম না বাড়ানোর জন্য। যদিও আমাদের এই শিল্পে টিকে থাকার জন্য এটা খুবই কঠিন। তবে এখনও বেকারি কারখানাগুলোতে প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে।’

বিএবিবিএমএ’র তথ্য মতে, গত ছয় মাসে প্রায় শতাধিক বেকারি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে- কামরাঙ্গীরচরের চায়না বেকারি, ফাতেমা বেকারি, মোহাম্মদপুরের খাজা বেকারি, নারায়ণগঞ্জের ইজি ফুড বেকারি, শনির আখড়ার মনি বেকারি উল্লেখযোগ্য।

মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের ব্রেড অ্যান্ড বান লাইনের মহাব্যবস্থাপক মো. শফিকুর রহমান বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি অবহেলার কারণে অনেক বেকারি তাদের বাজারে টিকে থাকতে পারেনি। তবে বাজারে পণ্যের চাহিদা রয়েছে। যদিও আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। সেই সাথে ভোক্তাদের জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস এবং রুচির পরিবর্তন হচ্ছে। এরপরও কিছু ভোক্তা এখনও হাতে তৈরি বেকারির খাবার কিনতে আগ্রহী।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাত দিনের সর্বাধিক পঠিত