সকল মেনু

পিপলস লিজিংয়ের ৩৩৫ কোটি টাকা শামসুল আলামিনের পকেটে!

ডেস্ক রিপোর্ট : পিপলস লিজিং লুটপাটের মূল কারিগর পিকে হালদার, বিষয়টি সবারই জানা। তবে এ কাজে তার বেশকিছু সহযোগীও ছিল। এর মধ্যে কয়েকজনের নাম প্রকাশ পেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে একাধিক রাঘববোয়াল। এমনই একটি গ্রুপ হলো শামসুল আলামিন গ্রুপ।

রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিনের এ কাজে সহায়তা করেছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মতিউর রহমান ও চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন এম মোয়াজ্জেম হোসেন।

ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় সংঘটিত অনিয়মে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরোক্ষভাবে এসব অর্থের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী আলমগীর শামসুল আলামিন গ্রুপ।

পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন প্রক্রিয়া চলার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক তথ্য চান উচ্চ আদালত। সেই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পিপলস লিজিংয়ে এত বেশি লুটপাট হয়েছে যে সূক্ষ্মভাবে তার হিসাব নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিকভাবে যেসব দায়দেনা ও দুর্নীতির কথা জানা গেছে প্রকৃতপক্ষে তা বহুগুণ বেশি হবে।

হাইকোর্টে পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, লুটপাট হওয়া দুই হাজার ১৭৫ কোট টাকার মধ্যে পিপলস লিজিং থেকে ৩৩৫ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নিয়েছিল শামসুল আলামিন গ্রুপ। এর মধ্যে ১৯১ কোটি টাকা সরাসরি লোন ও বাকি ১৪৪ কোটি টাকা মার্জিন লোন। এসব ঋণের বেশিরভাগ অর্থ পরিশোধ করে দেয়ার দাবি শামসুল আলামিনের।

সূত্র জানায়, কৌশলে সুদ মওকুফ করিয়ে সেই অঙ্ককে (৭৭ কোটি টাকা) পরিশোধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তবে মূল ঋণের বেশিরভারই পরিশোধ করা হয়নি। এছাড়া আইন অনুযায়ী, একই প্রতিষ্ঠানের বোর্ড সদস্যের সুদ মওকুফ করার কোনো সুযোগ নেই। আর সে সময় শামসুল আলামিন ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক।

হাইকোর্টের নির্দেশে একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টকে প্রতিষ্ঠানটি অডিট করার দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই অডিট রিপোর্টেও উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য। অডিট রিপোর্ট ও পিপলস লিজিং থেকে সরবরাহ করা তথ্যের মধ্যে ছিল ব্যাপক ফারাক। অডিট রিপোর্ট বলছে, পিপলস লিজিং থেকে ১৬৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে শামসুল আলামিন গ্রুপ। কিন্তু পিপলস লিজিংয়ের দাবি এই ঋণের পরিমাণ মাত্র ৯৭ কোটি।

অন্যদিক গ্রুপটির মার্জিন লোনের পরিমাণ ১৪৪ কোটি টাকা হলেও প্রতিষ্ঠানটির দাবি ৫৫ কোটি। শত গড়মিল থাকা সত্ত্বেও প্রস্তুতকৃত একনাবিনের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২১ জুলাই পর্যন্ত পিপলস লিজিংয়ের কাছে শামসুল আলামিন গ্রুপের দায় ছিল ৩৩৫ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঋণ হিসাবের তথ্য সিআইবি ডেটাবেজ এবং সিএল বিবরণীতে রিপোর্ট করা হয়নি এবং ঋণ বিতরণ করা হয়েছে পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পর্ষদের অনুমোদনের ভুয়া কাগজ তৈরি করা হয়েছে। অধিকাংশ নথিতে ঋণের আবেদন, ঋণ গ্রহণকারীর ব্যবসায়িক প্রোফাইল, কেওয়াইসি, চার্জ ডকুমেন্টস প্রভৃতি সংরক্ষণ করা হয়নি। কোথাও আবার বেনামি ঋণ হিসাব সৃষ্টি করে পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ঋণ সমন্বয় করা হয়েছে।

দুই হাজার ১৭৫ কোটি টাকার মধ্যে বাকি এক হাজার ৮৪০ কোটি টাকার অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমকে সামনে রেখে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অর্থ চুরি যাওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে দায়ী আলমগীর সামসুল আলামিনসহ তৎকালীন প্রত্যেক পরিচালক।

কারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ১৪(চ) এবং ১৪(৪) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি জামানতবিহীন ঋণ দেয়া যাবে না। যদি দেয়া হয় এবং ঋণ দেয়ার ফলে লোকসানের জন্য ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব পরিচালক যুগ্মভাবে এবং পৃথকভাবে ক্ষতিপূরণের জন্য দায়ী থাকবে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে অবহিত না করেই স্পন্সর শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। ই-সিকিউরিটিজের ১০০ টাকা মূল্যের এক লাখ ১৬ হাজার ৬৩১টি শেয়ার ৪৪৫ টাকা ৫০ পয়সা প্রিমিয়ামে মোট ৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকায় ক্রয় করা হয়। কিন্তু কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি ই-সিকিউরিটিজ।

মার্জিন লোনসহ ই-সিকিউরিটিজ সংশ্লিষ্ট অনিয়মের সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮২৩ কোটি ছয় লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এই অনিয়মের সঙ্গে শামসুল আলামিনের নিজেরও জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম পিপলস লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় অনুমোদিত জামানতবিহীন ১০২টি ঋণের স্থিতি ৭৯০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, যার পুরোটাই এখন খেলাপি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ১৪(৪) ধারা অনুসারে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ওই ৭৯০ কোটি ৩৯ টাকা ক্ষতিপূরণের জন্য সংশ্লিষ্ট অন্য পরিচালকদের সঙ্গে যুগ্মভাবে ও পৃথকভাবে দায়বদ্ধ। এই অনিয়মের সঙ্গে শামসুল আলামিনও জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১০ সালে নামসর্বস্ব কোম্পানি জেনিথ হোল্ডিংস এবং জেফায়ার হোল্ডিংসকে ঋণ দেয় পিপলস লিজিং। এই দুই কোম্পানির নামে ১২৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পিপলস লিজিংয়ে থাকা ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণ সমন্বয় করেন। ২০১৯ সালে লিপ্রো ইন্টারন্যাশনালের কাছে জমিটি বিক্রি করে ১২০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু কোনো মুনাফা দেননি। জমি বিক্রির অর্থ নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করায় ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১৭ শতাংশ সুদ হিসাব করলে পিপলস লিজিং লিমিটেডের প্রায় ২৯৮ ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গ্রেট ওয়াল ল্যান্ড প্রোপার্টি লিমিটেডের অনুকূলে পাঁচ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ওই ঋণের বকেয়া স্থিতি দাঁড়ায় ৭৭ কোটি ৮ লাখ টাকা, যা এখনও অপরিশোধিত।

পিপলস লিজিংয়ের অর্থে প্লেসমেন্টে এসএস স্টিল মিল্স লিমিটেডের ৬২ লাখ ৫৫ হাজার শেয়ার ক্রয়ের উদ্দেশ্যে ছয় কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমের নির্দেশে পিপলস লিজিংয়ের অনুকূলে ৩১ লাখ ৩০ হাজারটি শেয়ার এবং অবশিষ্ট ৩১ লাখ ২৫ হাজারটি শেয়ার তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, ই-সিকিউরিটিজ ও গ্রেট ওয়াল ল্যান্ড প্রোপার্টিজ লি. এবং তার ছেলে এহসান ই মোয়াজ্জেমের অনুকূলে বরাদ্দ করা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে বহু কাঠখড় পোড়ানের পর সেই টাকা ফেরত দেন ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম। তাতেও পিপলস লিজিংয়ের ক্ষতির পরিমাণ ছিল আট কোটি ৬৩ লাখ।

শুরুর পর থেকে পিপলস লিজিং একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালের পর থেকে প্রতিষ্ঠানে ঘুণপোকা ধরতে থাকে। এরপর অনিয়ম-দুর্নীতি টের পেয়ে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে পিপলস লিজিংয়ের পর্ষদ ভেঙে দেয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতেও নিস্তার পায়নি প্রতিষ্ঠানটি।

নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে সমাজে অপরিচিত, দুর্নীতিবাজ এবং বিভিন্ন বেনামি কোম্পানির লোকদের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। এরপর কোম্পানি থেকে অভিজ্ঞ যোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হুমকি ও মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে ন্যায্য পাওনা পরিশোধ না করেই অন্যায়ভাবে ক্রমাগত ছাঁটাই শুরু হয়। পাশাপাশি যোগ্যতা, গুণাগুণ, সততা ও অভিজ্ঞতার বিচার না করে উচ্চপদস্থ পদে পর্ষদের পছন্দমতো লোক নিয়োগ দেয়া হতে থাকে, যারা নতুন পরিচালকদের অন্যান্য কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন।

এসব কর্মকাণ্ড চালাকালে পিএলএফএসের দায়িত্বে ছিলেন আরাফিন শামসুল আলামিন, হুমায়রা আলামিন, নার্গিস আলামিন, মতিউর রহমান এবং বিশ্বজিৎ কুমার রায়। এখনও পিপলস লিজিংয়ের মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শামসুল আলামিন গ্রুপের মালিক ও রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) বর্তমান সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, পিপলস লিজিং থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়টি মিথ্যা নয়। কিন্তু তার বেশিরভাগ অর্থ আমরা পরিশোধ করে দিয়েছি। তাছাড়া সুদ মওকুফের বিষয়টিও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষেই। এই মুহূর্তে কোনো একটি গ্রুপ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

একনাবিনের অডিট রিপোর্ট ও পিপলস লিজিংয়ের দেয়া তথ্যে গড়বড়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অডিট ফার্মগুলো একেকবার একেক রকম তথ্য দেয়। আমার কথা হলোÑঅত বিষয় না দেখে কত টাকা স্যাংশন করা হয়েছে কি না তা দেখা উচিত। স্যাংশন অনুযায়ী আমাদের ঋণের পরিমাণ ১৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেশিরভাগই পরিশোধ হয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, পিপলস লিজিংকে আমরা আবার দাঁড় করাতে চাই। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠানটি পুনর্গঠনের জন্য একটি আবেদন করেছি। আমি, ফ্লোরার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এলআর গ্লোবালের এমডি মিলে একটা দরখাস্ত করেছি। আমরা এটাকে রিস্ট্রাকচারিং (পুনর্গঠন) করে চালাতে চাই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top