মূলত উচ্চহারে সুদ, মূল্যস্ফীতি ও অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের মুনাফা কমেছে। এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত ২১৩টি প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকের আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ৯৭ প্রতিষ্ঠান আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি মুনাফা করেছে।
আর ১১৬ প্রতিষ্ঠানের বা মোট প্রতিষ্ঠানের ৫৪ শতাংশের মুনাফা কমেছে।
মুনাফা অর্জনকারী ৯৭ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৮টি আগে লোকসান করলেও এবার তারা মুনাফা করেছে। অন্যদিকে, ১১৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩২টি কোম্পানি ২০২৩ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে মুনাফা করলেও এবার তারা নতুন করে লোকসানে পড়েছে।
সন্ধানী অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সংগ্রহ করা তথ্য বলছে—অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা গড়ে ১৬ শতাংশ বাড়লেও সেটি গত বছরের জানুয়ারি-মার্চের তুলনায় এখনও সাত শতাংশ কম।
তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে মুনাফা অনেক কমে গিয়েছিল, সেই প্রান্তিকের তুলনায় তাদের সম্মিলিত মুনাফা ২১ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে সম্প্রতি শেষ হওয়া প্রান্তিকে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের সভাপতি রূপালী হক চৌধুরী বলেন, দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার কমার পাশাপাশি মানুষের কেনাকাটা কমেছে। তাছাড়া মূল্যস্ফীতি বেশি থাকায় তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের খরচ বৃদ্ধি হওয়ার পরও সেই অনুযায়ী দাম বাড়াতে পারেনি ফলে মুনাফা কমেছে।
তিনি আরও বলেন, নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের উন্নয়ন কাজেও সরকারি খরচ কমেছে। পাশাপাশি অর্থনীতিতে কালো টাকার ব্যবহারও কমেছে। এগুলোর প্রভাব রয়েছে কোম্পানিগুলোর বিক্রি এবং মুনাফার উপর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে—জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র এক দশমিক ৮১ শতাংশ। করোনার কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের পর এটিই সর্বনিম্ন জিডিপি প্রবৃদ্ধি। একই সময়ে, শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দুই দশমিক ১৩ শতাংশ। এক বছর আগে ছিল আট দশমিক ২২ শতাংশ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ শতাংশ কমেছে।
রূপালী হক চৌধুরীর ভাষ্য, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা সংকটে থাকার মানে অর্থনীতি সংকটে আছে।
বিএপিএলসির সাবেক সভাপতি ও এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজম জে চৌধুরী বলেন, অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত জ্বালানি পাচ্ছে না। ব্যবসায় এর প্রভাব পড়ছে।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না। এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। একই সঙ্গে ক্রেতারা কেনাকাটা কমিয়েছেন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, ব্যবসা পরিচালন খরচ বেশি। তাছাড়া সামগ্রিক চাহিদা কম থাকায় মুনাফা কম। ব্যাংক ঋণের সুদহার যেমন বেড়েছে, তেমনি প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচও বেড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের মজুরিও বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে পণ্যের দাম সমন্বয় করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর ব্যাংক ঋণের গড় সুদের হার ছিল ছয় দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে তা ৫৫ শতাংশ বেড়ে ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ হয়েছে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সর্বশেষ পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্সের (পিএমআই) কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে তা আগের পর্যায়ে ফিরেনি। প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো কঠিন অবস্থায় পড়েছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত মুনাফা বেড়েছে মূলত কয়েকটি বড় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান মুনাফায় ফেরার কারণে।
টাকার দাম কমে যাওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠান আগে বড় লোকসানে পড়ার পর মুনাফায় ফিরেছে। ডলারের দাম স্থিতিশীল হওয়ায় সাম্প্রতিক প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা কমেছে। যেমন, ২০২৩ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের লোকসান হয়েছে ১১৪ কোটি টাকা।
২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ৩৯৮ কোটি টাকা মুনাফা করার আগে প্রতি প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয়েছে ৫০ কোটি টাকা থেকে ২৮৭ কোটি টাকা। একই পরিস্থিতি দেখা গেছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) ক্ষেত্রেও।
আজম জে চৌধুরী বলেন, পণ্যের বৈচিত্র্য কম হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঝারি আকারের ব্যবসা।
তার মতে, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক ধরনের পণ্য ও বিশাল বাজার থাকায় সেগুলো তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে আছে।
ইটিবিএল সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিজওয়ান রহমান বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। অনেক প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা ব্যাহত হয়েছে। ফলে মুনাফা কমেছে।
তার ভাষ্য, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। ক্রেতাদের কেনাকাটায় প্রভাব পড়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে—মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বরের ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ থেকে জানুয়ারিতে নয় দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমে এলেও ২০২৩ সালের মার্চ থেকে তা নয় শতাংশের ওপরে।
বর্তমান ব্যবসা পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান আরও বলেন, চলতি প্রান্তিকেও ব্যবসায় মন্দা থাকতে পারে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা সতর্কভাবে ব্যবসা করছেন।
অন্যদিকে, সরকার সম্প্রতি মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়িয়েছে। এটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমিয়ে দিতে পারে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপরও ব্যবসায়ীদের পর্যাপ্ত আস্থা নেই। এটি ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব ফেলতে পারে।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত দুই বছর ধরে ব্যবসায় বেশ উত্থান-পতন চলছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভালো করলেও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করতে পারেনি। মিউচুয়াল ফান্ডের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এরপর আছে নির্মাণ খাত।
এই প্রান্তিকে কিছু প্রতিষ্ঠান খুব ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের জানুয়ারি-মার্চে ৫০ কোটি টাকার লোকসান থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে ৩৯৮ কোটি টাকা মুনাফা করে।
এছাড়া স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের মুনাফা ২০২৩ সালের জানুয়ারি-মার্চে ৪২৮ কোটি টাকা থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে ৬৬০ কোটি টাকা হয়। স্থানীয় ও বিশ্ববাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এই সাফল্য এসেছে।
ডেসকোও ফিরে এসেছে লোকসান থেকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ১৪৫ কোটি টাকা লোকসান করলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা হয় ২৬ কোটি টাকা। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে এর মুনাফা ৯৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৮২ কোটি টাকা হয়।
প্রায় ৩৫ কোটি টাকা লোকসানের কারণে লোকসানে থাকা মালেক স্পিনিং ৫০ কোটি টাকা মুনাফা করে। বাজার অনুকূলে থাকায় প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা হয়েছে। তবে এই প্রান্তিকে কিছু কোম্পানি খুব খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছে। তিতাস গ্যাস গত অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করেছিল ৩৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয়েছে ৫২২ কোটি টাকা। প্রতিকূল নীতি ও পরিচালন অদক্ষতার কারণে এই লোকসান হয়।
এক সময়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো লিমিটেড গত অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ৭৩ কোটি টাকা মুনাফা করে। চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয় ২৪৩ কোটি টাকা।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।