ডেস্ক রিপোর্ট: ১৩ মাস যেতে না যেতেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তারিক আমিন ভূঁইয়ার পদত্যাগের পর জানা গেল তার আগের আরও দুই এমডির পরিণতিও একই হয়েছে।
কেন এমডিরা বারবার পদত্যাগ করেন- এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেয়ার কেউ নেই, তবে ফিসফিসানি আছে কোটারি স্বার্থের খেলা নিয়ে।
৯৫ কর্মকর্তার পদোন্নতি আটকে দেয়া নিয়ে পর্ষদের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে গত মঙ্গলবার হঠাৎ করেই দায়িত্ব ছেড়ে দেন তারিক আমিন, যার মেয়াদ ছিল আরও ২৩ মাস। যদিও এর আগে পর্ষদের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে পদোন্নতির আদেশে সই করে যান তিনি।
কর্মকর্তাদের পদোন্নতির এই সিদ্ধান্ত ছিল এমডির। তার এখতিয়ারেও ছিল এই সিদ্ধান্ত। সম্প্রতি এত বেশি কর্মকর্তার একসঙ্গে পদোন্নতির ঘটনা আর ঘটেনি, তবে এর মধ্যে আরও অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হননি।
তারা মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি ডিএসইর বোর্ডও এই সিদ্ধান্ত ভালোভাবে নেয়নি। তারা এমডিকে যে ভাষায় কথা বলেছে, সেটি পছন্দ হয়নি তারিকের। পরে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন।
তারিকের এই পদত্যাগের পর ডিএসইর বোর্ডের সঙ্গে তার মনোমালিন্যের বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর করে জানা গেল, এ নিয়ে পরপর তিনজন এমডি তিন বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেছেন।
পর্ষদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে গত বছরের ২১ অক্টোবর পদত্যাগ করেন তারিকের আগে এমডির দায়িত্ব পালন করা কাজী ছানাউল হক।
এক্সচেঞ্জটির ডিমিউচুয়ালাইজেশন তথা মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদা হওয়ার পরে গেলেন এই দুজন।
এর আগে ২০১২ সালের ২৮ মে পদত্যাগ করেন তৎকালীন ডিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন।
এমডির পদত্যাগের মধ্য দিয়ে একটি বিষয়ে জোরেশোরে আলোচনা চলছে। তা হলো ডিএসইর এমডির পদে কেউই পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেন না কেন?
ডিএসইতে পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে একটা দূরত্ব সব সময়ই চলে আসছে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পরও ব্যবস্থাপনার চেয়ে বেশি ক্ষমতা চর্চার প্রবণতা রয়েছে বোর্ডের মধ্যে। কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা এবং স্ব-অধিকারে দায়িত্ব পালন করতে না পারারও অভিযোগ রয়েছে এমডিদের।
অন্যদিকে তারিক আমিন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বোর্ডের সিদ্ধান্ত এবং আইন উপেক্ষা করে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়েছেন, বিভিন্ন বিভাগ ও পদ সৃষ্টি করেছেন।
তারিক আমিন ভূঁইয়া তার ব্যাখ্যায় জানিয়েছেন, ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইনের বলেই তিনি সব কাজ করেছেন।
সম্প্রতি ডিএসইর ৯৫ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হলে জরুরি বৈঠক করে সোমবার তা আটকে দেয় পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু পর্ষদের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে মঙ্গলবার সকালে পদোন্নতির ঘোষণা দেন তারিক। আর রাতেই ডিএসইর চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বরাবর ই-মেইলে পাঠান পদত্যাগপত্র।
ইউনুসুর বলেন, ‘পদত্যাগপত্রে তারেক আমিন ভূঁইয়া উল্লেখ করেছেন যে, ১৩ মাস দায়িত্ব পালনকালে তিনি অনেক কাজ করেছেন। নানা সমস্যার কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী অনেক কাজ করতে পারেননি। তাই উনার মনে হয়েছে, তার এ পদে না থাকা ভালো, তাই তিনি পদত্যাগ করেছেন।’
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ডিএসইর পর্ষদ সভায় তারিকের পদত্যাগপত্র গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এখন সংস্থাটিকে নতুন এমডি বাছাই করতে হবে। আপাতত ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করছেন প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সাইফুর রহমান মজুমদার।


কী বলছেন সাবেকরা
ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘এর জন্য সব সময় পরিচালনা পর্ষদকে দায়ী করা হতো যে, তারা ডিমিউচুয়ালাইজড না হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব বা একগুঁয়েমি ছিল। অভিযোগ ছিল অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার, ব্যক্তিগতভাবে প্রভাব বিস্তার করার।
‘তখন বোর্ডে স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন না। যেহেতু স্টক এক্সচেঞ্জের নিজস্ব পরিচালনা পর্ষদ, মালিকানা তাদের। এ জন্য তাদের দায়ী করা হতো যে, তারা সঠিক দায়িত্ব পালন করেন না। কাজেই এমডি তার মেয়াদকাল পূর্ণ করতে পারত না। এ জন্য সরকার মনে করেছেন স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিমিউচুয়ালাইজড করা দরকার, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ডিমিউচুয়ালাইজড হওয়ার পরও এমডিদের নিয়োগ প্রক্রিয়া ও অবস্থান, মেয়াদকাল পূর্ণ করার ব্যাপারটাও প্রশ্নবোধক থেকেই গেছে।’
তিনি বলেন, ‘ডিমিউচুয়ালাইজড হওয়ার পর মাজেদুর রহমান ও স্বপন কুমার বালা ছাড়া বাকি দুজনের মেয়াদকাল পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। ছানাউল হক মাস কয়েকের জন্য ছিলেন। সর্বশেষ তারিক আমিন ভূঁইয়া সবচেয়ে বিতর্কিত এবং প্রশ্নবোধকভাবেই বিদায় নিলেন।
‘ব্যক্তিগতভাবে তিনি সৎ, জ্ঞানী, প্রযুক্তি বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখেন। সেদিক থেকে তাকে নেয়া হয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক সাবেক পরিচালক বলেন, ‘তারিক আমিন ভূঁইয়ার বোর্ডকে অবজ্ঞা করা, কথা না শোনা বা বোর্ডকে ছোট করে দেখার প্রবণতা বা আরও অধিকতর ক্ষমতা তার সঙ্গে থাকা—এ চিন্তাটা মাথায় থাকাই তার জন্য কাল হয়েছে।
‘শুরু থেকেই তিনি বোর্ডের থেকে দূরে থাকেন। ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও করিৎকর্মা মানুষ হওয়ার পরও নিজের উপস্থাপন প্রক্রিয়ার মধ্যে আসলে কিছু সমস্যা দিনে দিনে দেখা দেয়।’
তিনি এও জানান, ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে তারিকের সঙ্গে পর্ষদের দ্বন্দ্ব ছিল। তারিক মনে করতেন, অর্ধেক টাকায় এটা সম্ভব, কিন্তু পর্ষদ বেশি খরচে আগ্রহী ছিল।
তিনি বলেন, ‘ডিএসইর প্রযুক্তির কাঠামোর উন্নয়নের জন্য আইটি থেকে একটি বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। পর্ষদে সেটি উপস্থাপন করার পর সমর্থন দেন বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র পরিচালক। এর ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
‘তারিক আমিন ভূঁইয়া দাবি করেন, এটা অর্ধেকের কম টাকায় করা সম্ভব। তিনি সেটি বোর্ডে উপস্থাপন করেন। এ নিয়েই ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদের একটি অংশের সঙ্গে প্রথম থেকেই উনার এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত এই দূরত্ব আর ঘুচল না।’
আরও একটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এমডির প্রভিশনারি পিরিয়ড শেষে তার যে পূর্ণ নিয়োগ হচ্ছিল না, এটাও পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে এমডির আরও মনোমালিন্যের কারণ।’
ডিএসইর সাবেক এমডি মাজেদুর রহমান বলেন, ‘অনেক বছর ধরে প্রমোশনগুলো আটকে আছে, এটা ঠিক না। এটা বোর্ডের এখতিয়ার না।’
তিনি বলেন, ‘শুনেছি, ম্যানেজমেন্ট এবং বোর্ডের মধ্যে একটু কনফ্লিক্ট সব সময়ই ছিল। মাসিক অনুষ্ঠানগুলোতে দেখেছি বোর্ডের কেউ যদি বসে থেকে দাঁড়ি-কমা ঠিক করেন এবং ম্যানেজমেন্টের কেউ সেখানে ক্যাপাসিটি তৈরি করার জন্য হেল্প না করেন, তাহলে ম্যানেজমেন্ট দিন দিন দুর্বল হতে থাকে। এখানে বড় ধরনের একটা বিষয় ছিল মনে হয়।’
ডিএসইর সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘ম্যানেজমেন্টের পুরো টিমের মধ্যেই ম্যাচিউরিটির অনেক অভাব রয়েছে। অনেক সময় এমন হয়ে থাকে এমডিকে মানতে চায় না। এ রকমটা দেখেছি যে, উনি তো চলে যাবেন তিন বছর পরে। থাকব আমরাই। যা করব আমাদের কথাই শুনতে হবে। এই ধরনের অ্যাটিটিউড একটা এক্সচেঞ্জের জন্য অনভিপ্রেত।’
তারিক আমিনের ব্যাখ্যা
এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের পদন্নোতি দেয়ার এখতিয়ার এমডির হাতে রয়েছে বলে জানান পদত্যাগী এমডি তারিক আমিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘এমডির যে অথরিটি, বোর্ড মনে করছে সেটা নাই। অথচ ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হেড ফুললি রেসপন্সিবল, হ্যাড ফুল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অথরিটি ফর ফিন্যানশিয়াল, এইচআর অ্যান্ড জেনারেল ম্যানেজমেন্ট।
কন্ট্রোল অ্যান্ড ডাইরেক্টিং স্টাফ, প্রমোশন এসবই এমডির এখতিয়ারের মধ্যে। এমনকি অর্গানোগ্রামও, কিন্তু উনারা মনে করছেন যে, ডিজিএমকে জিএম বানাতে পারি না। জিএমকে সিনিয়র জিএম বানাতে পারি না। এইচআরের ফুল অথরিটি রয়েছে এমডির। শুধু জিএমের রিক্রুটমেন্টের ক্ষেত্রে অনুমোদন নিতে হবে, দ্যাটস ফাইন।’
তিনি বলেন, ‘তারা এখন বলছেন, আপনি অর্গানোগ্রাম কেন চেঞ্জ করেছেন? ভালো কথা, গেজেটেড অর্গানোগ্রাম বইয়ে দেয়াই আছে, ওইখানে প্রপোজড লেখা আছে, দ্যাট ইজ দি ইনিশিয়াল অর্গানোগ্রাম। আমি আসার আগ পর্যন্ত এই অর্গানোগ্রাম আজ পর্যন্ত চেঞ্জ হয়নি।
‘ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের অবজেক্টিভে এক জায়গায় বলা আছে, এইচআর অবজেক্টিভ, টেকনোলজি অবজেক্টিভ, গভর্ন্যান্স অবজেক্টিভ, কমার্শিয়াল অবজেক্টিভ রয়েছে। এর মধ্যে এইচআরের অবজেক্টিভে বলা আছে, উই হ্যাভ টু এনশিওর অপটিমাম অর্গানোগ্রাম স্ট্রাকচার। অপটিমাম স্ট্রাকচার সবসময় অপটিমাম করতে হবে। আমার যাকে যেখানে লাগবে, যদি নতুন ডিভিশন করতে পারি, ডিভিশন করব, কোনো ডিভিশনকে ভাঙতে হলে ভাঙব, এটা তো একেকজন এমডি একেকভাবে করবে।’
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, ‘এমডির পদত্যাগের বিষয়ে জেনেছি। তাদের বোর্ড মিটিং করে তারা কিছু জানালে সে অনুযায়ী কাজ করা হবে।’
- তথ্য সূত্র : নিউজ বাংলা