স্টাফ রিপোর্টার: আর্থিক অনিয়ম ঢাকতেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানি ভার্চুয়ালি বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ও ইজিএম সম্পন্ন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হাইব্রিড মুডের (সরাসরি ও ভার্চুয়ালি/ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম) মাধ্যমে কোম্পানিগুলো এজিএম ও ইজিএম করা থেকে বিরত থাকছে।
অভিযোগ রয়েছে, এব্যাপারে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী গত কয়েক বছর ধরে অধিকাংশ কোম্পানির এজিএম ও ইজিএম ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সম্পন্ন হয়ে আসছে। কিন্তু দেশে গত বেশ কয়েক মাস ধরে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নেই বললেই চলে। এদিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু ভার্চুয়ালি এজিএম ও ইজিএম হওয়ায় অধিকাংশ কোম্পানির সারাবছরের আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতির চিত্র সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারলেও তা তারা সরাসরি বলতে পাচ্ছে না।
অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ কোম্পানি জবাবদিহিতার ভয়ে এসব সভায় তাদের পছন্দের বিনিয়োগকারীদের কথা বলার সুযোগ করে দেয়। ফলে সহজেই কোম্পানিগুলো এজিএম পাশ করে নেয়। সবচেয়ে আশ্চর্যেও বিষয় হচ্ছে-পুঁজিবাজারের রক্ষক বিএসইসি শুধু ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত সভার যে ক্ষতিকর দিক রয়েছে সেটি জানা স্বত্তেও এ ধরনের সভা অনুমোদন দিয়ে আসছে।
হাস্যকর বিষয় হচ্ছে, শুধু ভার্চুয়ালি সভা বন্ধের ব্যাপারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত কমিশন কোন ধরনের পদক্ষেপ নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ তাদের এ ব্যাপারে নিজেদের কোন দায়িত্ব নেই বলে প্রতিয়মান হয়। অর্থাৎ কমিশনের ক্ষমতা থাকা স্বত্তেও তারা সেটি প্রয়োগ করছে না কোন এক অজানা কারনে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসে ০১ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩২টি কোম্পানির এজিএম, ১টি কোম্পানির এজিএম ও ইজিএম এবং অপর একটি কোম্পানির শুধু ইজিএম ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর আজ থেকে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৫টি কোম্পানির ভার্চুয়ালি এজিএম, ২টি কোম্পানি এজিএম ও ইজিএম ও একটি কোম্পানির শুধু ইজিএম অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, কোম্পানিগুলো এজিএম, ইজিএম কোন পদ্ধতিতে করবে সে ব্যাপারে কমিশনের কোন দিক নির্দেশনা নেই। ফলে যে কোন পদ্ধতিতে এজিএম, ইজিএম করতে পারে কোম্পানিগুলো।
করোনা ভাইরাসের কারনে কমিশনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা ছিল যে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কোম্পানিগুলো ভার্চুয়ালি এজিএম, ইজিএম সম্পন্ন করবে, এ কথা তাকে বলা হলে তিনি বলেন, আমি এ ব্যাপারে এই মুহুর্তে কিছু বলতে পারবো না। আপনি কমিশনের এ ব্যাপারে নোটিফিকেশন দেখতে পারেন।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে রেজাউল করিম বলেন, কোন কোম্পানির কাছ থেকে যদি ভার্চুয়ালি এজিএম, ইজিএম সম্পন্ন করতে কমিশনের কেউ গোপন আতাতের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে থাকে তবে তার প্রমানসহ লিখিত অভিযোগ আসলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।
এডিএন টেলিকম লিমিটেডের সচিব মো. মনির হোসেন বলেন, কোম্পানিগুলোর এজিএম হাইব্রিড মুডে হওয়া উচিত। শুধু ভার্চুয়ালি হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের মনের ভাব ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না। করোনার কারনে কমিশন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এজিএম, ইজিএম করার অনুমতি দিয়েছিল।
যেহেতু এখন করোনার প্রাদুর্ভাব নেই সেহেতু আমার মনে হয় কমিশন এখন এটা নিয়ে চিন্তা করছে। আর অনেক কোম্পানি রয়েছে যারা আর্থিক অনিয়ম ঢাকতে ভার্চুয়ালি সভা করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। তারা আর্থিক হিসাবের জবাব দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে না বিনিয়োগকারীদের কাছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সাধারণ বিনিয়োগকারী অভিযোগ করে বলেন, হাইব্রিড মুডে যাতে এজিএম, ইজিএম না করতে হয় সেজন্য কমিশনের উর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে অধিকাংশ কোম্পানি গোপনে আতাত করে থাকে অর্থের বিনিময়ে। ফলে এ ব্যাপারে কমিশন চুপ থাকে।
রেজাউল করিম আরও বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সাথে কোম্পানিগুলোর বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ভার্চুয়ালি সম্পন্ন করলে সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। সুবিধা হচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভার্চুয়ালি সভায় অংশগ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া শুধু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বন্ধের ব্যাপারে কোন ধরনের অভিযোগ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখন পর্যন্ত কমিশনে করেনি। তারা অভিযোগ করলে আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করবো।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা চাই হাইব্রিড মুডের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর এজিএম সম্পন্ন হোক। শুধু ভার্চুয়ালি সভায় বিনিয়োগকারীরা মনের ভাব ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না। তাছাড়া বছরে কোম্পানিগুলো একটি করে এজিএম করে থাকে।
কোম্পানির ম্যানেজমেন্টে কারা আছে তা আমরা সরাসরি দেখতে চাই। আর আমাদের দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব এখন নাই বললেই চলে। যেখানে হাইকোর্টসহ বড়বড় সরকারী- বেসরকারী প্রতিষ্ঠান শুধু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে সরে এসেছে, তারা সরাসরি কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেখানে পুঁজিবাজারের অধিকাংশ কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলো শুধু ভার্চুয়ালি সম্পন্ন করা উচিত নয়।
কমিশনের উচিত পুনরায় কোম্পানিগুলোকে হাইব্রিড মুডে সভাগুলো সম্পন্ন করতে বাধ্য করা। পাশাপাশি এজিএম, ইজিএমের মনিটরিংয়ের জন্য কমিশন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) পক্ষ থেকে কমপক্ষে একজন করে প্রতিনিধি রাখা উচিত; যারা সৎ, নিষ্ঠাবান।