মানি মার্কেট এবং শেয়ার মার্কেটে সমান তালে সমালোচিত আদনান ইমাম। ব্যাংক লুট, ব্যাংকের কমিশন বাণিজ্য, মানি লন্ডারিং ও শেয়ারবাজার কারসাজির কারিগর তিনি। একাধিক সহযোগি নিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত আদনান ইমাম বেসরকারি এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান।
একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গিলবার্ট স্ট্রীট এস্টেটস লিমিটেডের পরিচালক তিনি।
শেখ হাসিনা সরকারের বিনিয়োগ উপদেষ্টা এবং ঋণ খেলাপিরজনক (বর্তমানে আটক) সালমান এফ রহমানের উত্তরসূরি। ব্যাংকের ঋণ সুবিধায় রপ্তানী করলেও রপ্তানীর সেই অর্থ দেশে আনতেন না এবং ঋণ পরিশোধও করতেন না। চতুর আদনান ইমাম সিন্ডিকেডের মাধ্যমে দখল করা প্রায় ১৫টি কোম্পানির মাধ্যমে পাচারের অপকর্ম করতেন।
একইসঙ্গে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সখ্যতা রেখে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ পাইয়ে দেয়া এবং সেই ঋণের বিপরীতে কমিশন নেয়ায় দক্ষ আদনান। আওয়ামী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শেয়ারবাজারে গত কয়েক বছরে শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে যেসব ব্যক্তি বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন- তাদের মধ্যে তিনি একজন। কারসাজির টাকায় বিশ্বের একাধিক দেশে প্রসাদ তৈরি করেন আদনান ইমাম। সেই টাকায় দুবাইয়ে করেছেন প্রসাদ, লন্ডন ও কানাডায় রয়েছে বাড়ি।
অন্যদিকে ঋণ খেলাপিরজনক (বর্তমানে আটক) সালমান এফ রহমানের নামে নিজেদের কেনা শেয়ার সাবেক গভর্নরের মাধ্যেমে বিভিন্ন ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কিনতে বাধ্য করেন। যদিও পরিবর্তিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুঁজিবাজারে কারসাজির দায়ে ৮ খলনায়কদের বিও হিসাব অবরুদ্ধ করেছে। হঠাৎ ৫ আগস্ট সরকার পতনে ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আগেই ব্যাংক ফাঁকা করে ফেলেন চতুর আদনান। কোটি কোটি টাকা কন্টিনারে ভরে বিদেশে পাচার করেন।
কুয়েতে দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের অনিয়ম-দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। টাকা পাচার অভিযোগে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ চার পরিচালককে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।
তার এই অপকর্মের মূলহোতা বা সহযোগি ছিলেন আশরাফ মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। এবি ব্যাংক লিমিটেডের প্রিন্সিপাল শাখার হিসাব (৪০০৫৭২৮২৯৫৩২০) নম্বরের মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্যসহ অন্যান্য টাকা ভাগাভাগি করতেন তারা।
রপ্তানি আয় উধাও
এনআরবিসি ব্যাংকের উত্তরা শাখার ছয়জন গ্রাহকের অন্তত ৩৪ কোটি ৪১ লাখ টাকার রপ্তানি আয় দেশে ফেরত আসেনি। তার মধ্যে পাঁচটি কোম্পানি ৯০ কোটি টাকার এলসির বিপরীতে কোনো ধরনের রপ্তানি করেনি।
২০২১ সালের ১৯ আগস্টে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, উত্তরা শাখা গত চার বছরে এই অর্থ এনআরবিসি ব্যাংক ফোর্সড লোন হিসেবে দেখায়। তথ্য আড়াল করে বিপুল পরিমাণ টাকা সাধারণ ঋণে রূপান্তরিত করা হয় এবং বারবার পুনঃতফশিল করা হয়েছে। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও মামলার নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। রপ্তানির অর্থ না আসার পরও রপ্তানি নথি জমা না দিয়েই অর্থ তুলে নেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটির সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত আছেন ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমাম।
পাচারের ঘটনায় গত বছরের ১১ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যাংকটির ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অভিযোগ করা হয়েছে, প্রতারণামূলকভাবে তারা ব্যাংক থেকে ৭৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ছয়টি কোম্পানির মধ্যে একচি হচ্ছে ইক্সোরা অ্যাপারেলস।
এনআরবিসির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, এনআরবিসি নিয়ে একাধিক তদন্ত হয়েছে এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে ১৫ কোম্পানি দখল
হাসিনা সরকারের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ইক্সোরা এ্যাপারেলস লিমিটেড নামের একটি রপ্তানীমুখী সোয়েটার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান দখল করে তার সিন্ডিগেড। শুধু ইক্সোরা নয়, পলিগন ফ্যাশন, রিল্যাক্স ফ্যাশন, ইনসাইড নিট কম্পোজিট, সাফি নিট, ফাইভ এফ এ্যাপারেলস, ব্লেসিংস নিটওয়্যার ও সিলভার এ্যাপারেলসসহ প্রায় ১৫টি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান দখল করে। এগুলোর মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকার অবৈধ ঋণ অনুমোদন, ঋণ জালিয়াতি এবং এর আড়ালে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
দখলের কোম্পানিতে ডলার পাচার তথ্য
ইক্সোরা অ্যপারেলস: দুদকের তদন্ত অনুসারে, ইক্সোরা অ্যাপারেলস ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পাঁচ কোটি ৯৭ লাখ টাকার পোশাকের ১২টি চালান যুক্তরাজ্যে পাঠিয়েছে। কিন্তু রপ্তানি আয় দেশে আনেনি। ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর এনআরবিসি ব্যাংকের ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন থেকে তৈরি করা নথি অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকটির বৃহত্তম ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ইক্সোরা ১৯তম।
ইক্সোরা অ্যাপারেলস: সোয়েটার ফ্যাক্টরির নাম ব্যবহার করে পাঁচ কোটি ৯৭ লাখ টাকা পাচার করা হয়েছে। রপ্তানির অর্থ না আসার পরও রপ্তানি নথি জমা না দিয়েই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয় এবং পরে সাধারণ ঋণ হিসেবে দেখানো হরেও তা পরিশোধ করা হয়নি।
পলিগন ফ্যাশন: এনআরবিসি ব্যাংকের ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কম্প্লায়েন্স ডিভিশনের (আইসিসিডি) ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পলিগন ফ্যাশন লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানি আট লাখ ৩৩ হাজার ৯২৮ মার্কিন ডলার বা নয় কোটি ১০ লাখ টাকার রপ্তানি আয় দেশে আনেনি।
২০২৩ সালে এনআরবিসি ব্যাংকের সবচেয়ে বড় খেলাপি ঋণগ্রহীতা হচ্ছে পলিগন ফ্যাশন। দখলে নেয়া পলিগনের মোট বকেয়া ঋণ গত নভেম্বরে দাঁড়িয়েছিল ৮৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। টাকা আদায়ে ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করা হয়েছে।
ব্লেসিং নিটওয়্যার লিমিটেড: ২০২১ সালের আইসিসিডি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ব্যাংকটির ২০তম বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা ছিল ব্লেসিং নিটওয়্যার লিমিটেড। কোম্পানিটির ছয় লাখ ৬১ হাজার ৮৫ ডলার (সাত কোটি ২০ লাখ টাকা) মূল্যের রপ্তানি আয় ব্যাংকে জমা করা হয়নি। আরও কয়েকটি এলসির বিপরীতে চালান করতে না পারায় ব্যাংককে আরও দুই দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার (২৫ কোটি টাকা) পরিশোধেও ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানিটি। ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর এসব ঋণকে সাধারণ ঋণে পরিণত করা হয়।
ইনসাইড নিট লিমিটেড: রপ্তানির তিন লাখ এক হাজার ১৯১ ডলার বা তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা ফেরত না দিয়ে ফোর্সড লোনে পরিণত করেছে।
ব্লেসিং নিটওয়্যার লিমিটেড: ২০২১ সালের আইসিসিডি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ব্যাংকটির ২০তম বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা ছিল। কোম্পানিটির ছয় লাখ ৬১ হাজার ৮৫ ডলার (সাত কোটি ২০ লাখ টাকা) মূল্যের রপ্তানি আয় ব্যাংকে জমা করা হয়নি। আরও কয়েকটি এলসির বিপরীতে চালান করতে না পারায় ব্যাংককে আরও দুই দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার (২৫ কোটি টাকা) পরিশোধেও ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানিটি।
ভাইব্রানিয়াম কোম্পানি ক্রয়
২০২১ সালে কোম্পানিটির ৮৩ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় ভাইব্রানিয়াম নামে আরেকটি কোম্পানি। ভাইব্রানিয়ামের নিবন্ধন নথি অনুযায়ী, এর চেয়ারম্যান বদরুল হাসান পাটোয়ারী। তিনি জেনেক্স ইনফোসিস নামে একটি কোম্পানির সেক্রেটারি। সেই জেনেক্স ইনফোসিসের চেয়ারম্যান আদনান ইমাম। মাত্র ১০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন দিয়ে চালু করা হয়েছিল ভাইব্রানিয়াম।
এনআরবিসি ব্যাংক কোম্পানিটির ঋণসীমা অন্তত আটবার নবায়ন করেছে এবং তিনবারই হয়েছে বদরুল হাসান পাটোয়ারী মালিকানা নেওয়ার পর। অথচ দুদকের মামলায় বদরুল হাসান পাটোয়ারীকে আসামি করা হয়নি।
আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছেন না ফজলে ইমাম
জেনেক্স ইনফোসিসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমাম, তিনি বেসরকারি ব্যাংক এনআরবিসির পরিচালক। তার বাবা চৌধুরী ফজলে ইমাম প্রতিষ্ঠানটির একজন পরিচালক। ফজলে ইমাম ২০২২ সালে এনবিআর-এর সঙ্গে ইএফডি মেশিন বসানোর চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তবে নির্ধারিত সময় পার হলেও মেশিন বসানো না হওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা বাতিল করে। অন্যদিকে শেয়ারবাজারে কোটি টাকা লেনদেন করা হলেও আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছেন না ফজলে ইমাম।
যুক্তরাজ্যের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী
দেশের বাইরে যুক্তরাজ্যের রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গিলবার্ট স্ট্রীট এস্টেটস লিমিটেডের পরিচালক তিনি। তার পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে একটি আদনানের স্ত্রী যৌথভাবে মালিকানাধীন। এই রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মূল্য ১০.৫২ মিলিয়ন ডলার বা ১৬৫ কোটি টাকার বেশি।
মালিকানাধীন বা সরাসরি সংযুক্ত ছয়টি কোম্পানিতে কমপক্ষে ১,৫১৬ কোটি টাকার ইউসিবি থেকে ঋণ সুবিধা নিয়েছেন তিনি। এডব্লিউ আর ডেভেলপমেন্টস (বিডি) লিমিটেড এবং এডব্লিউ আররিয়েল এস্টেট লিমিটেডকে ব্যাংক ৬১৭ কোটি টাকা, জেনেক্স ইনফোসিসকে ৪২৬ কোটি টাকা, বাংলা-ইউকে অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডকে ৩০২ কোটি টাকা, ফুলপুর এগ্রোসিটিকে ৫১ কোটি টাকা এবং টিএসএনট্রেড অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডকে ১২০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। তবে ঋণগুলোর মধ্যে কিছু মন্দ ঋণে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ব্যাংকে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন আর সিন্ডিকেটদের বসিয়ে অনিয়ম ও লুটপাট করলেও এখনো দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।