সকল মেনু

গমের দাম প্রতি টনে বেড়েছে ৫০০ ডলার, বেকারিখাত মহাসংকটে

নাঈম কামাল : পৃথিবীর রুটির ঝুড়িখ্যাত ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। অনেক দেশে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। যার বড় প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে।

দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে গতকয়েক মাস ধরেই চলছে চরম অস্থিরতা। এর মধ্যে হঠাৎ আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছে ভোজ্যতেল, বিশেষ করে সয়াবিনের দাম। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় যেমন অসহনীয় মাত্রায় বেড়েছে, তেমনি তেলনির্ভর খাদ্যপণ্য তৈরিও ব্যাহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি শঙ্কায় ফেলেছে দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য গম।

যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনে গম উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। রপ্তানিও বন্ধ করে দিয়েছে দেশটি। এতে বিশ্ববাজারে গত ১৪ বছরের সর্বোচ্চ দাম উঠেছে গমের। আর ইউক্রেন থেকে গম আমদানির তালিকার প্রায় শীর্ষে থাকা বাংলাদেশকেও পড়তে হয়েছে চরম বিপাকে।

বিকল্প হিসেবে যে ভারত থেকে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেখানে ঘটেছে বিপর্যয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে গমের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হঠাৎ করেই ভারত গম রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এতে অনেকটা অস্থির হয়ে উঠেছে গমের দেশীয় বাজার। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে বেড়ে গেছে ময়দা আর ময়দার তৈরি বেকারি খাদ্য উপকরণগুলোর দাম। বাড়তি অর্থের জোগান দিতে না পেরে টানাপোড়েনের মধ্য পড়ে গেছেন বেকারিখাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।

গমে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে রাজধানীর বেকারি কারাখানার উৎপাদনে। অনেকে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছেন। অনেকেই আবার উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনি একটি কারাখানা রাজধানীর নিউইস্কাটনের বেইলি রোডের সুইস বেকারি। গত প্রায় দেড় মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ চালু হবে অথবা আদৌ চালু হবে কিনা তা বলতে পারছেন না বেকারির কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে সুইস বেকারির ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন বলেন, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুব এক ভালো না। আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে, বাজারের অবস্থা দেখতে হবে। বাজার বিশ্লেষণ করে সবাই যদি উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় তখন আমরা হিসাব কষে দেখবো ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবে কি না। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

রাজধানীর পুরান ঢাকায় অবস্থিত পোলক বেকারিতে কাজ করেন প্রায় ৮০ জন কর্মচারী। বেকারির একটি বিক্রিয় কেন্দ্রে বসেন প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর ছেলে মো. মুহসিন। তিনি দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, কারখানায় কর্মরত সবাইকে ব্যবসার লাভ থেকেই বেতন দিতে হয়। হঠাৎ করে ভোজ্যতেলেরর দাম অস্বাভাবিক বাড়ার কারণে বিপদে আছি।

এর ওপর আবার গমের সংকট দেখা দিয়েছে বিশ্বব্যাপী। যার প্রভাবে ইতোমধ্যে দেশের বাজারে আটা-ময়দার দাম বেড়েছে। শুধু তাই নয়, সব ধরনের রাসায়নিক উপকরণের দামও বেড়েছে অনেক বেশি। বাধ্য হয়ে আমাদেরও দাম বাড়াতে হচ্ছে। এতে ক্রেতার সংখ্যা প্রতিনিয়তই কমছে। আগের মতো বেচা-কেনা নেই।

অনেক হতাশ সুরেই মুহসিন বলেন, একটা পণ্যের দাম কতবার বাড়ানো যায়? তেলের দাম বাড়ার পরে একবার দাম বাড়াতে হয়েছে। আটা-ময়দার দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। শেষ পর্যন্ত দাম কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটাই ভাবনার বিষয়। আমরা এখন বাজারের দিকে লক্ষ্য রাখছি। যেভাবে দাম বাড়ছে, তাতে হিসাবে গড়মিল দেখা দিচ্ছে। গত মাসে সাড়ে সাত লাখ টাকা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কোনোভাবেই হিসাব মিলাতে পারছি না। সামনে কি হবে আল্লাহই ভালো জানে।

রাজধানীর লালমাটিয়ায় অবস্থিত মুসলিম বেকারির ম্যানেজার মনির মোল্লা বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির কারণে বেকারিতে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়াতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বড় সমস্যাটা হচ্ছে, একের পর এক নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যে কারণে উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এখন আবার নতুন করে আটা-ময়দার দামও বাড়ছে। যেগুলো বেকারির প্রধান কাঁচামাল। আটা বা ময়দার দাম বাড়লে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে সেটা পুষিয়ে নিতে হয়। অথচ ক্রেতার বিষয় মাথায় রাখলে দাম বাড়ানো যায় না। এমনিতে দাম বাড়ার কারণে দিন দিন ক্রেতা কমেই যাচ্ছে।

লালমাটিয়ার এই বেকারিতে কাজ করছেন প্রায় ৫০ জন কর্মচারী। তাদের কেউ উৎপাদনে কেউ বা বিক্রির কাজ করছেন। বিক্রয়কর্মীদের ভাষ্য, আগের তুলনায় এখন ক্রেতার সংখ্যা অনেক কম। যারা কিনতে আসছেন তারাও দাম নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করছেন। উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়ায় প্রতিনিয়তই ক্রেতাদের প্রশ্নে জর্জরিত হতে হচ্ছে।

সূত্রমতে, মানুষের খাদ্যাভাস পরিবর্তনের কারণে দেশে গত কয়েক বছরে বেকারিশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। শহরের পাশাপাশি গ্রাম অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে বেকারিকারাখানা। যেসব কারাখানায় উৎপাদিত পণ্য দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। গত অর্ধযুগ আগেও যেখানে দেশে পাঁচ হাজারের মতো বেকারি ছিল, বর্তমানে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে আটা বা ময়দার দাম বাড়ার ধাক্কায় নড়বড়ে হয়ে উঠেছে বেকারিগুলোও। লোকসানে পড়ে অনেক কারাখানাতেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন অনেক কর্মী।

সূত্রমতে, শুধু এক শরীয়তপুর জেলাতেই এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে ৯৬টি বেকারি কারখানা। এর ওপর আবার গমের দাম বাড়ার শঙ্কায় বন্ধের পথে অনেক বেকারি। জেলা বেকারি মালিক সমিতি জানাচ্ছে, শরীয়তপুরে ছোট বড় মিলিয়ে বেকারি ৯৬টি। এগুলো বিস্কুট, টোস্ট, চানাচুর, কেক, পাউরুটিসহ নানা খাদ্যপণ্য উৎপাদন করে। তেল ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে বেকারিগুলো উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। অনেকে আবার বেকারি ব্যবসা ছেড়েই দিয়েছেন।

মালিকদের দাবি, দফায় দফায় তেল, চিনি, ময়দার দাম বাড়ায় লোকসানের মুখে পড়েছেন তারা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে আটা ময়দার দাম কেজিতে বেড়েছে ১০-১২ টাকা। বর্তমানে বেকারি টিকিয়ে রাখতে হলে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। এমন বললেও তাদের শঙ্কাও রয়েছে, ভোক্তাদের সাড়া না পেলে উল্টো ঘটনা ঘটবে।

এদিকে, সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্যমূল্য তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত শনিবার খুচরা বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিকেজি আটা সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ ও ময়দার দাম ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। আর মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি আটা সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ ও ময়দার দাম ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। অথচ বছরের ব্যবধানে খোলা আটার দাম ৫০ শতাংশ ও খোলা ময়দা ৬৭ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশ অটো-বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন অনুসারে, দেশের বিস্কুট ও কনফেকশনারি বাজারের আকার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার। ২৫ শতাংশ অংশ নিয়ে বাজারের শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে অলিম্পিক। ৮ শতাংশ শেয়ার ধরে রেখে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে আছে নাবিস্কো বিস্কুট এন্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

বাংলাদেশ অটো-বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন অনুসারে, দেশের বিস্কুট ও কনফেকশনারি বাজারের আকার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার। ২৫ শতাংশ অংশ নিয়ে বাজারের শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে অলিম্পিক। ৮ শতাংশ শেয়ার ধরে রেখে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে আছে নাবিস্কো বিস্কুট এন্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

সূত্রমতে, গত কয়েক মাসেই গমের দাম টন প্রতি বেড়েছে প্রায় হাজার ডলার। যা ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। গেল বছরের নভেম্বর থেকে গমের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। গেল বছরের সেপ্টেম্বরে গমের টন প্রতি দাম ছিল ২৬৪ ডলার। এক মাস পর নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩৫ ডলারে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩৩ ডলারে। দুমাস পর গত এপ্রিলে বেড়ে হয় ৬৭৩ ডলার প্রতিটন। অথচ গত ১৩ মে হঠাৎ করেই প্রতিটন গমের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৭৮ ডলারে।

এদিকে, সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্যমূল্য তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে গত শনিবার খুচরা বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিকেজি আটা সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ ও ময়দার দাম ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। আর মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি আটা সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ ও ময়দার দাম ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। অথচ বছরের ব্যবধানে খোলা আটার দাম ৫০ শতাংশ ও খোলা ময়দা ৬৭ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন বলেন, সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্ম্য প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এতে অস্থিতিশীল হচ্ছে বাজার। মুখ থুবড়ে পড়ছে বেকারিখাত। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ জরুরি। তা না হলে যে কোনো সময় কাজ হারিয়ে পথে বসতে হবে ২০ লাখ শ্রমিককে। কষ্টে গড়া এ খাত এভাবে হারিয়ে গেলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে দেশের।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top