সকল মেনু

৩৫০ কোটি টাকার জমি ৮৫ কোটিতে বিক্রি, অন্ধকারে বিনিয়োগকারীরা

সিনিয়র রিপোর্টার: সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের অন্ধকারে রেখে প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকা মূল্যের জমি মাত্র ৮৫ কোটি টাকায় বিক্রি করেছে বস্ত্র খাতের কোম্পানি আশরাফ টেক্সটাইল মিলস। ২০০৬ সালে জমি বিক্রির ঘটনায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবিরও সায় ছিল।

সেই জমি বিক্রির টাকা কখন, কী কাজে খরচ করেছে- তার কোনো সদুত্তর নেই কোম্পানির কাছে। এ অবস্থায় পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।

বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক ওহিদুল ইসলামকে প্রধান করে গঠন করা তদন্ত কমিটির অপর সদস্য হলেন এ সংস্থারই সহকারী পরিচালক মো. মাহমুদুর রহমান। ডিএসইর সিনিয়র পর্যায়ের এক কর্মকর্তাকেও কমিটিতে যুক্ত করতে আদেশ দিয়েছে বিএসইসি।

বিএসইসির কর্মকর্তারা জানান, ২০০৬ সালের ১৬ জানুয়ারি পরিচালনা পর্ষদ সভা করে কোম্পানিটি কিছু ভবনসহ জমি বিক্রি করে কারখানা অন্যত্র স্থানান্তরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিনই ইজিএম করে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।

ইজিএমে জমি বিক্রি এবং বিক্রির অর্থ কীভাবে খরচ করা হবে, সে বিষয়ে শেয়ারহোল্ডারদের ধারণা দেওয়া হয়নি। তারপরও একক সর্বোচ্চ শেয়ারহোল্ডার হিসেবে আইসিবি প্রতিনিধি জমি বিক্রির এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। কোম্পানিটির দাবি, ইজিএমে ১ হাজার ৩৬২ শেয়ারহোল্ডার উপস্থিত ছিলেন। যদিও সে সময় এ বিষয়ে বিএসইসিকে কোনো তথ্য দেননি তাঁরা।

আইসিবির পক্ষে সেই ইজিএমে অংশ নেন প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মো. ফায়েকুজ্জামান। পরে তিনি আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যান। আশরাফ টেক্সটাইলের জমি বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বয়স হয়েছে। এটা অনেক আগের ঘটনা, এখন কিছু মনে নেই। এ বিষয়ে আশরাফ টেক্সটাইলের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

আশরাফ টেক্সটাইল সংশ্নিষ্ট একজনের সূত্রে জানা গেছে, জমি বিক্রির পর সব যন্ত্রপাতিও বিক্রি করে এ কোম্পানি ২০০৬ সাল থেকে পুরোপুরি বন্ধ। কারখানা স্থলে গড়ে তোলা হয়েছে আশরাফ-সেতু শপিং কমপ্লেক্স। এই শপিং কমপ্লেক্সের এ আয় কার কাছে যায়, তার তথ্য মেলেনি। প্রায় দেড়যুগ ধরে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেওয়ার রেকর্ড নেই।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা জমির ক্রেতা ছিল পার্শ্ববর্তী শিল্পপ্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী ইন্ডাস্ট্রিজ। পর্ষদ ও ইজিএমে অনুমোদনের পর প্রথমে ভবনসহ ৩২ বিঘা সাড়ে ১৬ কাঠা জমি মাত্র ৭৫ কোটি টাকায় এবং পরে আরও প্রায় সাড়ে ৯ বিঘা জমি ১০ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়।

টঙ্গীর শিল্প এলাকার ওই জমি প্রথমে বিঘা প্রতি মাত্র ২ কোটি ২৯ লাখ টাকায় বা কাঠা প্রতি সাড়ে ১১ লাখ টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় কাঠা প্রতি মাত্র ৫ লাখ ৩২ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। বিএসইসি মনে করছে, কম মূল্যে জমি বিক্রি করে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেছেন সংশ্নিষ্টরা।

জমি বিক্রির পর সব যন্ত্রপাতিও বিক্রি করে মালিকপক্ষ। এতে উৎপাদন বন্ধ হয়।

এ বিষয়ে কোম্পানিটি কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করেনি। জমি বিক্রির টাকা থেকে ব্যাংক ঋণসহ কিছু দায়দেনা শোধ করে অন্যত্র কারখানা স্থানান্তরের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু ব্যাংক ঋণসহ মোট প্রায় ২৮ কোটি টাকার দায় শোধ করে আর কিছু করা হয়নি। অন্যত্র জমি কেনা বা কারখানা স্থাপন হয়নি।

এখনও আশরাফ টেক্সটাইলের প্রায় ২৪ বিঘা জমি রয়েছে। বর্তমানে এ কোম্পানি পরিশোধিত মূলধন সাড়ে ১০ কোটি টাকা, যার প্রায় ৭৫ শতাংশের মালিক সাধারণ শেয়ারহোল্ডার।

বিএসইসি বলেছে, কোম্পানির সম্পদ, জমি, ভবন এবং যন্ত্রপাতি বিক্রির বিষয়ে তথ্য শেয়ারহোল্ডারদের কাছে যথাযথভাবে প্রচার করা হয়নি এবং শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে যথাযথ অনুমোদন পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিক বলেন, কমিশনের উচিত ওটিসি মার্কেটের আওতাধীন প্রতিটি কোম্পানির তদন্ত করা। যদি নিয়ন্ত্রক তহবিল আত্মসাৎসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পায়, তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

কোম্পানির প্রাক-আইপিও পরিশোধিত মূলধন ছিল ৪০ লাখ টাকা এবং বর্তমান পরিশোধিত মূলধন ১০.৫০ কোটি টাকা। কোম্পানিটি তার শেয়ারের ডিম্যাট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেনি, যা সিকিউরিটিজ নিয়মের লঙ্ঘন।

ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে ওভার-দ্য-কাউন্টার মার্কেটে (ওটিসি) শেয়ার লেনদেন হতো। ১৬ সেপ্টেম্বর, বিএসইসি ওটিসি বাজার বাতিল করে এবং আশরাফ টেক্সটাইল মিলসহ ১৬টি কোম্পানিকে দেশের স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষুদ্র মূলধনী প্ল্যাটফর্মে লেনদেন করার অনুমোদন দেয়।

২০১২ সালের নিরীক্ষকদের রিপোর্ট অনুযায়ী, কোম্পানিটি ২০০৬ সালে তার উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এবং তারপর থেকে সব যন্ত্রপাতি বিক্রি করতে শুরু করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্পদের বাজার মূল্য হতে পারে ৩২৫.৫ কোটি টাকা। সে তুলনায় অনেক কম দাম বলা হয়েছে। সুতরাং, বিক্রয় মূল্য তৎকালীন বাজার মূল্যের তুলনায় যথেষ্ট কম বলে মনে হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top