Homeঅনুসন্ধানী প্রতিবেদনবে-লিজিংয়ে লোকসানের গন্ধ পেয়েই সব শেয়ার বিক্রি

বে-লিজিংয়ে লোকসানের গন্ধ পেয়েই সব শেয়ার বিক্রি

ডেস্ক রিপোর্ট: সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক সদস্য আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে গোপনে তথ্য জেনে শেয়ার বিক্রির (ইনসাইডার ট্রেডিং) অভিযোগ উঠেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের গত বছরের নিরীক্ষিত প্রতিবেদন প্রকাশের অনেক আগেই নিজের হিসাব থেকে এ কোম্পানির সব শেয়ার বিক্রি করে দেন তিনি।

এভাবে শেয়ার বেচে আলমগীর কবির প্রায় আড়াই গুণ মুনাফা তুলেছেন। তাঁর স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠান সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস থেকেও প্রচুর শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। বে-লিজিংয়ের আর্থিক প্রতিবেদনের যথার্থতা এবং ইনসাইডার ট্রেড নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এ বিষয়ে তদন্তে নেমেছে বিএসইসি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব শেয়ারবাজারের আইনে ইনসাইডার ট্রেডিং গুরুতর অপরাধ।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে প্রথম ধসের সময় আলমগীর কবির বিএসইসির সদস্য ছিলেন। তিনি কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। পরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার তাঁকেসহ সে সময়কার অন্য সদস্যদের অপসারণ করেছিল। আলমগীর কবির এখন সাউথইস্ট ব্যাংকের পাশাপাশি সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেসেরও চেয়ারম্যান। মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের পর কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়তে বা কমতে পারে।

সাধারণত বেশি মুনাফা পেতে বা লোকসান কমাতে ইনসাইডার ট্রেড করা হয়। কোম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক, শীর্ষ কর্মকর্তাসহ তাঁদের পরিবারের অন্য সদস্যরা ‘ইনসাইডার’ হিসেবে বিবেচিত হন। আলমগীর কবির শেয়ারবাজারে ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের ক্ষতিকর দিক এবং এ-সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়টি জানেন।

বিএসইসি সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন, বে-লিজিংয়ের অন্যতম ইনসাইডার হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আগে জেনে আলমগীর কবির এবং তাঁর স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করেছেন।

আলমগীর কবির সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য জানতে পারেন এমন ব্যক্তিদের অন্যতম। তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া বেগম বে-লিজিংয়ের উদ্যোক্তা পরিচালকদের একজন, পরিচালক তারিক সুজাত ভাগনে আর পরিচালক জুবায়ের কবির তাঁর ভাতিজা। স্বতন্ত্র পরিচালক জাইদি সাত্তার সাউথইস্ট ব্যাংক ফাউন্ডেশনের পরিচালক। আবার শেয়ারহোল্ডার হিসেবে বে-লিজিংয়ের ইভিপি এম মনিরুজ জামান খান সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক পদেও আছেন।

এ ছাড়া সাউথইস্ট ব্যাংক এবং ব্যাংকটির মালিকানাধীন সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস বে-লিজিংয়ের শীর্ষ শেয়ারহোল্ডার। ২০১০ সাল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সাউথইস্ট ব্যাংক এবং সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস বে-লিজিংয়ের প্রায় ২০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিল।

বর্তমানে সাউথইস্ট ব্যাংকের মালিকানায় আছে ১ কোটি ৪০ লাখ ১২ হাজার ৪০৫টি শেয়ার, যা আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেসের মালিকানায় গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বে-লিজিংয়ের ১ কোটি ৩৬ লাখের বেশি শেয়ার ছিল, যা ছিল ওই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ২০২১ সালে প্রায় ১৪ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। এর আগে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন প্রান্তিক মিলিয়ে ৯ মাসের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল গত ২৮ অক্টোবর। ওই ৯ মাসে কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল প্রায় ৩৯ কোটি টাকা।

নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য প্রকাশের আগে মুনাফার এ তথ্যই সাড়ে ১০ মাস ধরে জানতেন শেয়ারহোল্ডাররা। তবে পুরো হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর জানা যায়, শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) লোকসান হয়েছে প্রায় ৫৩ কোটি টাকা। প্রথম ৯ মাস ধারাবাহিক মুনাফা করার পর শেষ তিন মাসে তার চেয়েও বড় অঙ্কের লোকসান বিএসইসির কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়েছে।

সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা লোকসানের এই তথ্য গত সেপ্টেম্বরে জানলেও গত ডিসেম্বর শেষেই ইনসাইডারদের এ তথ্য জানার সুযোগ ছিল। ধারণা করা হয়, গোপন এ তথ্য জেনে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বে-লিজিংয়ের অন্যতম প্রধান শেয়ারহোল্ডার সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস ১ কোটি ৩৬ লাখ শেয়ার থেকে ১ কোটিরও বেশি বিক্রি করে। এ ছাড়া সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির তাঁর ব্যক্তিগত বিও হিসাবে থাকা প্রায় ৪০ লাখ শেয়ারের পুরোটাই বিক্রি করেন।

তদন্ত কমিটি : বে-লিজিংয়ের আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতে গত ২২ সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটি করে বিএসইসি। কমিটিকে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রান্তিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য যাচাই করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে কোনো ইনসাইডার ট্রেডিং হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়।

একটি সূত্র জানিয়েছে, ইনসাইডার ট্রেডিং হয়েছে এমন প্রাথমিক তথ্য জেনেই তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সব ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের কাছে এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য থাকলে তা জানাতে চিঠি দিয়েছে।

এপ্রিল থেকে জুনে শেয়ার বিক্রি : প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নিজের নামে থাকা বে-লিজিংয়ের সব শেয়ার আলমগীর কবির বিক্রি করেছেন গত এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে। এসব শেয়ার তিনি এক যুগেরও বেশি সময় রেখেছিলেন। এখন তাঁর বিও হিসাবে বে-লিজিংয়ের একটি শেয়ারও নেই। গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেসের নামে বে-লিজিংয়ের ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬৫ হাজার ২০৯টি শেয়ার ছিল। এখন আছে মাত্র ৩০ লাখ শেয়ার। গত জানুয়ারিতে মার্চেন্ট ব্যাংকটি ৪১ লাখ ৫৫ হাজার এবং ফেব্রুয়ারিতে ৬১ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার প্রায় ৩৫ কোটি টাকা মূল্যে বিক্রি করে।

ফ্লোর প্রাইসে বে-লিজিং : গত ফেব্রুয়ারিতে শেয়ারটির দর সর্বোচ্চ ৩৭ টাকায় উঠেছিল, এরপর থেকে ক্রমাগত কমছে। এখন ফ্লোর প্রাইস ২৩ টাকা ৯০ পয়সায় পড়ে আছে। বিপুল বিক্রেতার বিপরীতে এর ক্রেতা নেই। ফ্লোর প্রাইস না থাকলে দর আরও কমার শঙ্কা ছিল।

২০২১ সালের প্রথম ৯ মাসে অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস দেখিয়েছিল ২ টাকা ৭৫ পয়সা। তবে বছরের শেষে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বছরজুড়ে শেয়ারপ্রতি নিট ৯৯ পয়সা লোকসান হয়েছে। বিএসইসি কর্মকর্তারা মনে করেন, এ তথ্য খুবই অস্বাভাবিক। এ সময়ে দেশের আর্থিক খাতে বা ব্যবসা-বাণিজ্যে এমন বড় কোনো নেতিবাচক অবস্থা ছিল না, যার কারণে এত বড় লোকসান হতে পারে।

এ ব্যাপারে কথা বলতে কয়েকদিন আলমগীর কবিরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে এসএমএস পাঠানো হয়। ওই এসএমএস তাঁর নজরে এলেও তিনি সাড়া দেননি।

জানতে চাইলে সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এয়ার কমডোর (অব.) মো. আবু বকর বলেন, যখন এ শেয়ার বিক্রি হয় তখন আমি অসুস্থতাজনিত কারণে অফিস করিনি।’

তিনি বলেন, স্বাভাবিক লেনদেনের অংশ হিসেবে বে-লিজিংয়ের শেয়ার বিক্রি হয়েছে। ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের অভিযোগ সঠিক নয়।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাত দিনের সর্বাধিক পঠিত